Blog

Congue iure curabitur incididunt consequat

দেশের সর্বযুগের সেরা ১০০ জন রাজনৈতিক নেতা

কেএইচএন রিসার্চ টিমঃ 

 

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের নানা দিক নিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রেখে যাওয়া হচ্ছে প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও প্রতিবেদন। গবেষণা সম্বলিত এমন উদ্যোগে পুস্তক পড়ে, জাতীয় দৈনিক পড়ে এবং ইন্টারনেট ব্যবহারকারী জনগোষ্ঠী কোনো এক সময়ে উপকৃত হবেন বলে অনুমিত হয়।

 

“দেশের রাজনীতি, জনপ্রতিনিধি, শাসন রীতি, সংবিধান, জাতীয় নির্বাচন, স্থানীয় সরকার, রাজনৈতিক দল প্রভৃতি নিয়ে গবেষণারত সংস্থা কেএইচএন রিসার্চ টিম এবার জানান দিয়েছে, তাঁরা বাংলাদেশের সর্বযুগের সেরা একশত রাজনীতিকদের নাম ঘোষণা করবে। ১ জুন, ২০২০- এ এমন ঘোষণা দেয়া হয়। রাজনৈতিক গবেষণার উপর দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে এই উদ্যোগটিকে অর্থবহ প্রয়াস হিসাবে দেখবার সুযোগ আছে বলে দেশের বিদগ্ধশ্রেণি ইতোমধ্যে মত প্রকাশ করেছেন। 

এমন ধারাবাহিকতায়  আগস্ট ২৪, ২০২০  তারিখ হতে ধারাবাহিকভাবে পর্যায়ক্রমে দেশের কৃতি সন্তানদের নাম ঘোষণা করা হচ্ছে। চার যুগের চেয়ে একটু বেশী বয়সী স্বাধীন বাংলাদেশের বরেণ্য রাজনৈতিক বর্গের জনপ্রিয়তা, কর্মদক্ষতা  ও নেতৃত্বের ওপর ফলত এই গবেষণা চলবে বলে মত রেখেছেন সংস্থাটির প্রধান গবেষণা কর্মী কামরুল হাসান নাসিম

নাসিম বলেন, ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীকে সামনে রেখে পঞ্চাশ বছরের বাংলাদেশে আমরা অভিভাবক হিসাবে যাদেরকে পেয়েছিলাম, তাঁদেরকে স্মরণ করার পাশাপাশি যারা এখনো মাটি ও মানুষের জন্য লড়ে যাচ্ছেন—- তাঁদের নামের তালিকা প্রকাশে আমরা কাজ করছি। আমরা এই একশত রাজনীতিকদের নাম শুধু নয়, তার সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্ত, কর্ম, ঐতিহাসিক ভুমিকা, সামাজিক রাজনৈতিক পরিচিতি তুলে ধরবার মাধ্যমে ভিন্ন ধারার সংস্কৃতির অনুশীলন করতে চাই। যেখানে যিনি ১০০ স্থান অধিকার করবেন, তিনিই দেশের সেরা একশত রাজনীতিকের শেষ প্রতিনিধি। যিনি ১ নং স্থানে থাকবেন, তিনিই গেল পঞ্চাশ বছরের শ্রেষ্ঠ রাজনীতিক হিসাবে বিবেচিত হবেন।  সর্বযুগের শ্রেষ্ঠ !

তিনি বলেন, “দেশিয় রাজনীতির ওপর আমরা প্রায় আঠার বছর ধরে গবেষণা করে আসছি। বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ধরণ, শিক্ষাগত যোগ্যতা, মেধা, দক্ষতা, দূরদৃষ্টি, দেশপ্রেম, সু-বক্তা হওয়া, চরিত্র, ঘটনা প্রবাহের ওপর দ্রুত সিদ্ধান্ত দেয়া, জাতীয় সংসদে ভুমিকা, টক শোতে দক্ষতা, বাচনভঙ্গি, জাতীয় রাজনীতিতে ভুমিকা, বৈশ্বিক রাজনীতি ও বোধ, পররাষ্ট্রনীতি, প্রতিরক্ষানীতি, সামাজিক ছদ্দাবরনে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করা— এমন নানা কিছুকে অগ্রাধিকার দিয়ে এই গবেষণা চলছে।”

নাসিম বলেছেন, “আমার নেতৃত্বে পুরোনো ও নতুন কর্মীদের নিয়ে টানা ৮০ দিন কাজ করবার পর আমরা এই তালিকা প্রকাশে মনোযোগি থাকছি।   টানা ১৮ বছর ধরে আমরা বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিক প্রেক্ষিতের ওপর গবেষণারত আছি। যা পুস্তক আকারে প্রামাণ্য গ্রন্থ প্রকাশ সহ, ওয়েব পোর্টালে পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়েছে, তুলে ধরা হয়েছে দেশের জাতীয় দৈনিক গুলোয় গবেষণা সম্বলিত প্রতিবেদন প্রকাশের নানা দিক।  এবার আমরা আমাদের অফিসিয়াল সাইটে এই গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা সম্বলিত তালিকা প্রকাশে থাকবো। এরপর তা বাংলাদেশের দুইটি জাতীয় দৈনিকে সম্পূর্ণ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হবে এবং পুস্তক প্রকাশের উদ্যোগে যেয়ে নতুন প্রজন্মের জন্য তা শিক্ষনীয় উদাহরণ হয়ে রয়ে যাবে। অতি অবশ্যই নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের যোগ্যতার ভিত্তিতেই স্থান মিলবে বলে আশা করছি। ”

কামরুল হাসান নাসিম বলেন, “জরিপ এবং গবেষণার মধ্যকার পার্থক্য রয়েছে। এমন উদ্যোগটি জরিপের মাধ্যমে নেয়া হলে শুধুমাত্র ‘জনপ্রিয়তা’ কে গ্রাস করে অর্থবহ বাস্তবতাকে মৃত করে পরিকল্পনাটিকে নিরাশ করত। কারণ, বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ এখনো মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করে না, ভাল ও মন্দ বাছতে পারার যোগ্যতায় নেই। তাঁরা সামাজিক- সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে শিক্ষিত নন।  সঙ্গত কারণেই গবেষণার মাধ্যমেই আমরা বাংলাদেশের ৫০ বছরের শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক নেতাদের মূল্যায়ন করতে চাই।

 

এদিকে এই গবেষণায় দেশের ৪০০ জন রাজনীতিক স্থান পান। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় হতে শুরু করে ২০২০ সাল পর্যন্ত, যারা রাজনীতির জন্য অবদান রেখেছেন, তাঁদের সংক্ষিপ্ত নামের তালিকা করেই কাজটিকে অর্থবহ করবার উদ্যোগে যাওয়া হয়েছে। দেখা হয়েছে বিশেষত চারটি দিক। এক, সততা। দুই, নেতৃত্ব। তিন, দক্ষতা। চার, বিশেষ ভুমিকা। 

 

গেল তিনটি প্রতিবেদনে প্রকাশিত তালিকায় যারা স্থান নিয়েছিলেন তাঁরা হলেন, 

 

১০০ 

লেঃ জেঃ মাহবুবুর রহমান 

৯৯

ইসরাফিল আলম

৯৮

কর্নেল অলি আহমেদ 

৯৭

জি এম কাদের 

৯৬

আমির হোসেন আমু 

৯৫

হান্নান শাহ 

৯৪ 

মোহাম্মদ নাসিম 

৯৩

মিজানুর রহমান চৌধুরী

৯২

এবিএম মহিউদ্দীন চৌধুরী

৯১

আবুল মনসুর আহমেদ

৯০

আলতাফ হোসেন গোলন্দাজ 

৮৯

তরিকুল ইসলাম

৮৮ 

হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী

৮৭ 

নজরুল ইসলাম খান 

৮৬ 

শফিকুল গাণি স্বপন 

 

পূর্ববর্তী দুইটি প্রতিবেদন পড়তে নীচের লিংক-এ ক্লিক করুন। 

সর্বযুগের সেরা একশত রাজনীতিক ( প্রথম ধাপ)

সর্বযুগের সেরা একশত রাজনীতিক

তাঁরা বাংলাদেশের যুগশ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক নেতা

 

 

বাংলাদেশের সর্বযুগের সেরা রাজনীতিকদের তালিকায় যারা ৮৫,৮৪,৮৩,৮২,৮১ স্থানে জায়গা করে নিলেন, চলুন সে সকল সম্মানিত রাজনীতিক বর্গ সম্যক জেনে নেয়া যাকঃ 

 

৮৫ 

আব্দুল মান্নান 

 

 

তাঁর চরিত্রের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হল, গোষ্ঠিগত এবং জাতীয় স্বার্থে ক্ষমতাসীন দল থেকে সরে যেয়ে বলতে পেরেছিলেন, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী রাজনীতির বিকল্প প্ল্যাটফর্ম খোঁজা দরকার। আর সে কারণেই বিকল্পধারা বাংলাদেশ নামক রাজনৈতিক দলটির জন্ম হয়েছে বলে সোচ্চার হয়ে দীপ্ত উচ্চারণে থেকেছিলেন। সেই তিনি সাম্প্রতিক সময়েও (২০১৭-২০) সংবাদমাধ্যম কে বলেছেন, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল– বিএনপি ( ২০০১-২০০৬) ছেড়ে দিয়ে আমরা কোনো ভুল করেছিলাম না।

 

এদিকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আব্দুল মান্নান নামে অনেক খ্যাতনামা রাজনীতিকই এসেছেন। কিন্তু, দেশের যুগশ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক নেতৃত্বের তালিকায় ১০০’র মধ্যে স্থান করে নেয়া এই রাজনীতিক কে জনশ্রেণি চেনে একজন মেজর ( অবঃ) আব্দুল মান্নান হিসাবে। যাকে কখনই দেশ স্বাধীনের পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে কথা বলতে দেখা যায় নাই। বরং তিনি রাজনৈতিক সভা সেমিনারে মুক্তিযুদ্ধ, একজন বঙ্গবন্ধুকে অতি সম্মান প্রদর্শন করে নিজের আদর্শিক অবস্থান নিশ্চিত করেছেন। রাজনীতিতে তিনি আশির দশকের শেষভাগে আসেন।  বাংলাদেশের রাজনীতি ও একজন মেজর মান্নান কে নিয়ে গবেষণার খোরাকে যাওয়া হয়েছে। সেখানে অতি অনুসন্ধানী তৃতীয় চোখের ফলাফল বলছে, তিনিও ইতিহাসের সেরাদের একজন, যাকে খুব বেশী কাজে লাগাতে পারেনি প্রিয় বাংলাদেশ।

 

জনাব আবদুল মান্নান ২ জুলাই  ১৯৪২ সালে নোয়াখালী জেলার সোনাপুরের দক্ষিণের চর শুল্যকিয়া ইউনিয়নের ইসহাকপুর গ্রামে এক প্রভাবশালী জমিদার পরিবারে জন্ম নেন। তাঁর পিতার নাম মৃত ইসহাক মিয়া। মাতা প্রয়াত রোকেয়া বেগম।  চার ভাই চার বোনের মাঝে তিনি সবার বড়। তিনি নোয়াখালী জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক পর্যায় শেষ করে ফেনী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি তদানীন্তন পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৬২ সালে তিনি পাকিস্তান সামরিক শিক্ষালয় থেকে বিএসসি পাস করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর আবদুল মান্নান পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ছেড়ে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীতে যোগদান করেন। ১৯৭৪ সালে সামরিক বাহিনী থেকে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।

 

এদিকে অবসর গ্রহণের পর আজিম মান্নান গার্মেন্টস নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে যা সানম্যান গ্রপ নামে পরিচিত, সু পরিচিত। তিনি ফলত শিল্পোদ্যক্তা। ১৯৮০’র দশকে পোশাক কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে তিনি  বিশেষ সাফল্য লাভ করেন। বাংলাদেশে ওয়াইম্যাক্স ইনটারনেট সার্ভিস প্রদান করে দেশে তিনি পথিকৃৎ চরিত্র হয়ে দাঁড়ান।  তিনি বাংলা লায়ন ওয়াইম্যাক্স এবং বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিনান্স কোম্পানি লিমিটেডের চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। সানম্যান গ্রুপ ছাড়াও তিনি বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পর্যায়ের হল, ইস্টার্ন ইন্সুরেন্স লিমিটেড, পানীয়, এয়ারলাইন্স ও ওষুধ ব্যবসা ইত্যাদি।

 

মেজর মান্নান রাজনীতিক হিসাবে হৈচৈ ফেলে দেন। কখন?  যখন এরশাদ সরকারের পতনের পর ‘বাংলাদেশ’ সংসদীয় গণতন্ত্রের যাত্রায়  নতুন এক আশা নিয়ে দেশ পুনর্গঠনকে আলিঙ্গন করতে চায়। ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-১০ আসন থেকে নির্বাচন করে মেজর মান্নান হারিয়ে দিয়ে বসেন আজকের( ২০০৮-২০২০…)  প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে। রাজনৈতিক অঙ্গনে তখন তিনি এক আলোচিত সত্তা হয়ে পড়েন। সে ধারাবাহিকতায় তিনি বিএনপি নেতৃত্বধীন সরকারের বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। একই সঙ্গে নির্বাচনী এলাকার সন্ত্রাস রোধ এবং ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিখারুন নুন নেসার শিক্ষার উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তেমন জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে তিনি ১৯৯৬ ( ১৫ ফেব্রুয়ারী) ও ২০০১ সালেও সাংসদ নির্বাচিত হন।

মেজর মান্নান দেশব্যাপী জাতীয় আলোচনায় এসে পড়েন, যখন জাতীয়তাবাদী রাজনীতির জ্যেষ্ঠ সজ্জন সত্তা অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী নেতৃত্বাধীন বিকল্পধারা বাংলাদেশ নামক রাজনৈতিক দল জন্ম নেয়। আর একজন আব্দুল মান্নান ক্ষমতাসীন দলের সাংসদ হয়েও তিনিও বিদ্রোহ করে বসেন বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের ওপর। উল্লেখ্য, এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় ঐক্য জোটের নতুন সরকারের রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন।

মেজর আব্দুল মান্নান এবং তাঁর সহকর্মীদের ২০০৪ হতে ২০০৬ সালের মধ্যে সরকার দলের বিমাতাসুলভ আচরণের শিকার হতে হয়। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে দেয়া সহ দৈহিক এবং মানসিক আক্রমণের অমন নির্যাতন সহ্য করেই বিকল্পধারা বাংলাদেশ জাতীয় রাজনীতিতে নতুন দিগন্তের সূচনা করতে চেয়েছিল। পরবর্তীতে ২০০৬ সালের নির্বাচন ঘিরে বাংলাদেশের ডাকসাইটের প্রায় শতাধিক জাতীয়তাবাদী নেতা আরেক আলোচিত রাজনীতিক কর্নেল অলি আহমেদ এবং বি চৌধুরীর ওপর আস্থা রেখে এলডিপি দলে যোগ দিলেও  রাজনৈতিক মতানৈক্যে ইতিহাস সৃষ্টি করতে তাঁরা ব্যর্থ হয়—- যখন, ১/১১ সরকারের মেয়াদের পর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাঁরা যার যার প্ল্যাটফর্ম নিয়ে রাজনীতি করতে বাধ্য হয়।

 

মেজর আব্দুল মান্নান এখনো সেই বিকল্পধারা বাংলাদেশ এর নেতৃস্থানীয় চরিত্র। তিনিই এখনো দলটির মহাসচিব। সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে( ২০১৮) তথা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি  খানিকটা সবাইকে অবাক করে দিয়ে  লক্ষ্মীপুর-৪ থেকে নির্বাচন করেন। নির্বাচনী এক অভিনব কৌশলে যুক্তফ্রন্ট্রের প্রার্থী হয়ে তাঁকে দেশের আরেক লেজেন্ডারি রাজনীতিক আসম আব্দুর রবকে পরাভূত করতে বেগ পেতে হয় নাই। তিনিই এখন সাংসদ।

 

একজন মান্নানের ব্যক্তি চরিত্রের সবচাইতে বড় গুন হল, তিনি সজ্জন মানসিকতার। অন্যদিকে তিনি মিষ্টভাষি ও সদালাপী। তাঁর ব্যবসায়িক জীবনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বৈশ্বিক অর্থনীতির সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যেত। কারণ, তিনি আন্তর্জাতিক বাজারের হালচিত্র বুঝতে পারার যে কয়জন মুষ্টিমেয় ব্যক্তিসত্তা এই দেশে আছেন, তিনি তাঁর অন্যতম। শিল্পের বিকাশ, নিত্য নতুন প্রযুক্তি এবং ব্যবসার ধরণকে বাংলাদেশের সাথে পরিচিত করানোয় তাঁর জুড়ি নেই। তিনি রাজনীতিক হিসাবে সফল। দেশিয় রাজনীতির সরু সড়কে পথিক হয়ে দ্বিদলীয় রাজনৈতিক গোষ্ঠির অবিরত চাপেও দুমড়িয়ে না যেয়ে মেজর মান্নানও যেন এক অদম্য সত্তা।  বিপ্লবী মানসে থেকে অর্থনৈতিক জ্ঞান মনষ্ক এই চরিত্রটি  জাতীয়তাবাদী রাজনীতির বিকাশে তৃনমূল থেকে শুরু করে দেশের উচ্চ পর্যায়ে হয়তো তাঁর দলের বিস্তারে ভুমিকা রাখতে পারেন নাই। তবে, অন্যায়, অবিচার এবং রুগ্ন রাজনীতির প্রতিবাদ করে মেজর (অবঃ) আব্দুল মান্নান জায়গা করে নিয়েছেন রাজনৈতিক ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম— যেখানে তিনি বলছেন, “নেতৃত্ব, দক্ষতা, দেশপ্রেম আমার মাঝে ছিল, কিন্তু  বড়সড় পরিসরে কাজ করবার জন্য ভাগ্য খুব বেশী সহায়ক হিসাবে ছিল না, হয়তো তা ঈশ্বর চায় নাই। সেরাটা আমার হয়ে হয়তো একদিন দেশের জন্য পারিবারিক উত্তরসূরীরা করবে…

 

৮৪ 

আব্দুল কুদ্দুস মাখন 

 

তিনি, চার খলিফার একজন। খলিফা ? হ্যাঁ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা চেয়ে যারা অদম্য হয়ে হানাদার বাহিনীকে রুখতে চাইতো। বলতো, শেখ মুজিব আমাদের নেতা। তিনি আমাদের বঙ্গবন্ধু। চলো ঝাঁপিয়ে পড়ি। মেধাবী ছাত্র হিসাবে ১৯৭১ সালে ১লা মার্চ গঠিত স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের চার সদস্যের অন্যতম হয়ে তিনি অপর তিন সদস্য  জনাব নূরে আলম সিদ্দিকী, জনাব শাহজাহান সিরাজ ও জনাব আ স ম আবদুর রবকে নিয়ে ২রা মার্চ ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সম্মুখে সর্ব প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে হয়ে যান বিপ্লবী। ৩ মার্চ। ১৯৭১ পল্টন ময়দানের ঐতিহাসিক ছাত্র জনসভায় স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দৃপ্ত শপথ গ্রহণ করা হয় এবং এই ঐতিহাসিক জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার প্রথম ইশতেহার পাঠ করা হয় এবং ওই ইশতেহার থেকে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীত নির্ধারণ করে ঘোষণা প্রদান করা হয়। স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কর্তকৃ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই ঐতিহাসিক জনসভায় অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। গোটা জাতি এই অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে সাড়া দেন। এমন উদ্যোগের সাংগঠনিক পর্যায়ে ঐতিহাসিক ভুমিকা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনীতি ও কৌশল প্রণয়ন করে আব্দুল কুদ্দুস মাখন ইতিহাসের পাতায় নিজের নামকে রঙ্গীন করে ফেলেন।

আব্দুল কুদ্দুস মাখন,  ১৯৪৭ সালের ১ জুলাই ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়  জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ থেকে উচ্চ-মাধ্যমিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। ১৯৭০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের (ডাকসু) সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন।

এদিকে সত্তরের দশকের শুরুতে দেশে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনে মাখন অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বাঞ্চলীয় সেক্টরের অধীনে তিনি মুজিব বাহিনীর অন্যতম সংগঠক ছিলেন। মাখন ১৯৭৩ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। জনাব মাখন মাত্র ৪৭ বৎসর বয়সে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস জনিত জন্ডিস রোগে আক্রান্ত হয়ে লিভার সিরোসিসে ভুগে ১৯৯৪ সালে ১০ ফেব্রয়ারি  মৃত্যুবরণ করেন।

আমেরিকার  ফ্লোরিডায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যু সংবাদ রেডিও, টিভিতে প্রচারিত এবং সংবাদ পত্রে প্রকাশিত হবার পর গোটা দেশে শোকের ছায়া নেমে আসে। তৎকালীন সময়ে কার্যরত জাতীয় সংসদ অধিবেশন তাঁর মৃত্যুর সংবাদ প্রাপ্তির সাথে সাথে মুলতবি ঘোষণা করা হয়।  তাঁর লাশ ঢাকা বিমান বন্দরে পৌছলে জাতীয় নেতৃবৃন্দ, অসংখ্য গুণগ্রাহী ও শুভাকাংখী অশ্রসিক্ত নয়নে লাশ গ্রহণ করেন।

 আব্দুল কুদ্দুস মাখন ইতিহাসের সেই রাজনীতিক, যিনি খানিকটা কবি সুকান্তের মত করে …  অল্প বয়সে গ্রহান্তরীত না হলে এই মেধাবী রাজনীতিক বাংলাদেশকে আরো কিছু দিতে পারতেন বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।

একজন মাখনের মধ্যে সাংগঠনিক দক্ষতা যেমন ছিল, ছিল মেধার অনুরণনে রাজনীতি করবার সবিশেষ দিক। তিনি আঞ্চলিক রাজনীতিতেও সফল ছিলেন।  ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাটি ও মানুষের নেতা ছিলেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রায় মানুষই তাঁকে ‘মাখন কুদ্দুস’ হিসাবে ডাকতেন। তিনি অতি সহজেই সব মানুষকেই অতি আপন করে নিতে পারতেন। তাঁর প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস ছিল অগাধ। অতি অনায়াসেই যে কেউ তাঁর নিকট পৌঁছতে পারতেন। তিনি ধৈর্য ধরে সকলের কথাই শুনতেন। যে কোন লোকের যে কোন সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি মনে প্রাণে চেষ্টা করতেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শিক্ষা বিস্তার, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশ, ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষা, বিভিন্ন শিক্ষা, সাহিত্য ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপনে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা, শিল্প ও কল-কারখানা স্থাপন, কৃষকদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান, এলাকার জনগণের সুবিধার্থে রাস্তা-ঘাট নির্মাণ ও উন্নয়ন, এলাকার জনগণের জন্য গ্যাস ও বিদ্যুৎ সুবিধা নিশ্চিতকরণ, সাধারণ মানুষের চিকিৎসা সেবা প্রদান, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ ইত্যাদি কার্যক্রমে তিনি সব-সময়ই অগ্রণী ভুমিকা পালন করেছেন।

উল্লেখ্য, তৎকালীন সময়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের অনেক ছাত্র-ছাত্রীকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যাপারে তিনি প্রয়োজনীয় সাহায্য ও সহযোগিতা করেছেন। তাঁর প্রচেষ্টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হবার সুযোগ পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে অনেক ছাত্র-ছাত্রীর থাকার ব্যবস্থাও করে দিয়েছেন।

তিনি ছিলেন সর্বদাই হাস্যোজ্বল। তাঁর মুখ জুড়ে ছিল থাকতো শিশুসুলভ কোমল ছায়া। তিনি অতি ভদ্র, বিনয়ী এবং খুবই অমায়িক ছিলেন। অতি সহজ সরল মন ছিল তাঁর। বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ শ্রদ্ধাবোধ। সে জন্যে, যে কোন পেশার বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিগণ জনাব মাখনকে দারুণ পছন্দ করতেন। মাখনের আয়ুকাল দীর্ঘ হলে তিনি দেশসেবায় ব্রত হয়ে বাংলাদেশের জন্য আরো কাজ করতে পারতেন বলে দেখার অবকাশ আছে।  তাঁর অকাল বিদায় হলেও দেশের শ্রেষ্ঠ পর্যায়ের একজন রাজনীতিক হিসাবে তাঁর নামকে রুখতে পারার ক্ষমতা টা যে কারোর নেই।

 

৮৩ 

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম 

 

শৈশবে তিনি অনেক কিছুই হতে চেয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, বিজ্ঞানী হয়ে যন্ত্র আবিষ্কার করবেন। শৈশব ও কৈশোরে তিনি অভিনয়ও করেছিলেন। তবে সব কিছু পাল্টে দিল খালাতো ভাই বামপন্থী আলোচিত নেতা মনজুরুল আহসান খান। যার  কাছ থেকে পাওয়া কমিউনিস্ট ইশতেহার বা কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো। তখন তিনি এসএসসির ছাত্র। দুনিয়া পরিবর্তনের এই ছোট্ট পুস্তিকাই তাঁর জীবনে গভীর পরিবর্তন আনল। ক্রমে তিনি রূপান্তরিত হতে থাকলেন সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াকু সৈনিকে। হ্যাঁ, চলুন, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এর গল্প শুনি।

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এর জন্ম ১৯৪৮ সালের ১৬ এপ্রিল ঢাকার অদূরে সাভারে। বাবা মোসলেহ উদ্দিন খান ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা আর মা উম্মে হানী খানম ছিলেন নারীনেত্রী ও সমাজসেবক। স্কুল জীবনে স্কাউটসহ নানাবিধ সামাজিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন। স্কুলছাত্র থাকাকালীন ১৯৬৬ সালে আউযুব খানের বিরুদ্ধে মিছিল করতে গিয়ে সেলিম কারাবরণ করেন। কলেজে পা দিয়েই সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন বামপন্থী ছাত্র আন্দোলন ও রাজনীতিতে। এ সময় তিনি গোপনে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গেও যুক্ত হন। তিনি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি ছিলেন। সেলিম স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) প্রথম সহ-সভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অনার্স ও মাস্টার্স করেন। 

বাংলাদেশের বামপন্থী রাজনীতির নানা বিভক্তির মধ্যে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের নেতৃত্বে তাঁর পার্টি সিপিবি অনেক সংকটের মধ্যেও কাজ করে যাচ্ছে বলে মত অনেকের।  তাঁরা বলছেন, “মর্ত্যবাসীর স্বর্গে মানুষে-মানুষে ভেদাভেদ ঘুচিয়ে শ্রেণীহীন সমাজ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে ভ্লাদিমির ইলিচ উইলিয়ানভ লেনিন ১৯১৭ সালে যে বিপ্লব করেছিলেন রাশিয়ায়, পরবর্তী বছরগুলোয় সারা পৃথিবীতে এর চেয়ে শক্তিশালী মতাদর্শিক বা চেতনার ঝড় আর বয়ে যায়নি। কৃষক-শ্রমিকের সাধের সেই সমাজতন্ত্র বালির বাঁধের মতো ধসে পড়েছে রাশিয়া থেকে। রাশিয়ার প্রিয় লেনা নদীর নামের সঙ্গে মিলিয়ে নিজের নাম রেখেছিলেন লেনিন। কিন্তু সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনের পর শুধু রাশিয়া থেকে নয়, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের জনক কার্ল মার্ক্সের জন্মস্থান জার্মানি থেকেও ‘গুড বাই লেনিন’ জানানো হয়। সেখানে জায়গা করে নিয়েছে আধুনিক পশ্চিমাদের পাবের নগ্ন নৃত্য, হ্যামবার্গারের সঙ্গে কোকা-কোলার ককটেল পার্টি। চেয়ারম্যান মাও জে দংয়ের লাল চীন কবেই যাত্রা করেছে পশ্চিমাদের বণিকতন্ত্রের ভোগবিলাসে। সমাজতন্ত্রের এমন নিদারুণ পরাজয়ে সারা পৃথিবীর বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যবিত্তরা এত বিবর্ষ হয়েছেন, যেন তাঁরা সবাই ‘দ্য আউটসাইডার’-এর একেকটি অবিকল নায়ক চরিত্র। এ রকম সময় বরং কোনো বহুজাতিক কম্পানির সুউচ্চ কাচঘেরা ঘরে কফির সঙ্গে বৃষ্টির পতনের গান অনেক বেশি আনন্দ আর বেঁচে থাকার জন্য ঢের তৃপ্তিদায়ক। তবু তো কেউ কেউ অতীতের কথা বলেন। মনে করিয়ে দিতে চান, বিপ্লব আসন্ন। ‘একটু জোরে পা চালিয়ে কমরেড।’ এ রকম জোরে পা চালানোর কথা যাঁরা বলেন, এখনো শ্রেণীহীন সমাজ, রাষ্ট্র বিপ্লব সম্পন্ন করার রাজনীতির চেষ্টা যাঁরা করে যাচ্ছেন, তাঁদের একজন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম।”

এদিকে জনাব সেলিম  রাজনীতি শুরু করেন সারা দুনিয়ার কমিউনিস্টদের রুশ-চীনা বিভক্তির যুগে। রুশপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সখ্য বজায় রাখেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর বাকশাল ভেঙে দিলে আবারও কমিউনিস্ট পার্টি স্বনামে ফিরে আসে। পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো দেশের একটি কমিউনিস্ট পার্টি কোনো বুর্জোয়া দলের ভেতরে বিলীন হওয়ার ইতিহাস এটাই হয়তো প্রথম। এর ফলে পরবর্তী সময়ে সিপিবির ভেতরেও সমালোচনা হয়। সম্ভবত এ কারণেই  আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট গঠনের পর সিপিবি দূরত্ব বজায় রেখেছে।

ইতিহাস দাবী করছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে প্রতিরোধযুদ্ধে তিনি ছিলেন সবার আগে। ‘মুক্তি না হয় মৃত্যু’- এই স্লোগান নিয়ে তিনি চলে যান ভারতে। ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টির যে গেরিলা বাহিনী গঠিত হয়েছিল, সেই বাহিনীতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সেলিম প্রথম ব্যাচে ট্রেনিং নিয়ে পূর্বাঞ্চলীয় সেক্টরে অপারেশন কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন।

বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদে সরব ছিলেন তিনি : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবার নির্মমভাবে নিহত হওয়ার পর শুধু খুনি মোশতাকই নয়, তৎকালীন আওয়ামী লীগের বহু নেতাই তখনকার সরকারে যোগ দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লাশ পড়ে আছে ৩২ নম্বরে আর আওয়ামী লীগের বহু নেতাই নতুন মন্ত্রিপরিষদে শপথ নিচ্ছেন। তখন শেখ মুজিবের নাম নেওয়াটাও ছিল অপরাধ। অথচ মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ১৫ আগস্টই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। পরে ৪ নভেম্বর ঢাকার রাজপথে বের হয় বিক্ষোভ মিছিল। সেটাই ছিল নেতার মৃত্যুর পর প্রথম সংগঠিত কোনো প্রতিবাদ। জেলখানায় জাতীয় চার নেতার মৃত্যুর প্রতিবাদে সেলিম ৫ নভেম্বর হরতাল আহ্বান করেন। এসবের কারণেই তাঁকে কারাবরণ করতে হয়। বিনা বিচারে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত তিনি কারারুদ্ধ থাকেন।

মুজাহিদুল ইসলামেরা রাজনীতিতে ব্যর্থও হয়েছেন বলে দাবী অনেকের। প্রতিবেশী দেশের  পশ্চিমবঙ্গে মধ্যপন্থী বাম ধারা ক্ষমতায় যেতে পারলেও বাংলাদেশের বাস্তবতায় তা অলীক কল্পনার মত করে হয়ে দাঁড়িয়েছে। শ্রেণি সংগ্রামের নামে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি কায়েম করত এই রাজনীতিকে ‘হ্যাঁ’ বলাতে পারেনি বাম বলয়। বরং ধীরে ধীরে দেশে আস্তিক শক্তির অতি আনাগোনায় বিভোর হয়ে এখানে ধর্মভিত্তিক সমাজ গঠনে মনোযোগী অনেকেই। বড় রাজনৈতিক দলগুলোও তাই কৌশলী। তাঁরা বাম ধারাকেও কৌশলে ধরে রাখতে চায়, আবার আস্তিক শক্তিকেও পেতে চায়।

সারাবিশ্বে ফলত বাম ধারার রাজনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে। পুঁজিবাদের দংশনে তাই  গণতন্ত্র ও সুশাসন কে সভ্য সমাজের শাসন ব্যবস্থা বলে মেনেও নিতে হচ্ছে তাঁদের। হেরে যাচ্ছে তাই প্রকারন্তরে মার্কসবাদ। কিন্তু, আদর্শিক রাজনীতির চূড়ান্তে সিদ্ধান্তে থেকে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম রয়ে গেছেন আগের জায়গাতেই। এখানেই তিনি দৃষ্টান্ত। যা বিশ্বাস করেন, তা প্রজন্মকে বোঝাতে চান। এই রাজনৈতিক  পথচলা খুব ছোট পরিসরে এগোলেও তা ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত উপস্থাপিত করে। সঙ্গত যুক্তিতে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমকেও ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ করে। কিন্তু তাঁর উদ্দেশে বাংলাদেশের দার্শনিক কামরুল হাসান নাসিম বলছেন এবং তিনি নিজেকে পৃথিবীর ইতিহাসের সেরা দার্শনিক দাবী করেই বলছেন, “আত্মহত্যা করা মহাপাপ, কিন্তু, এটি করেও যদি তুমি অনাগত  অন্তত প্রায়  তিনশত কোটি মানুষের সুবোধ জাগরণে নিবেদিত সেই ত্যাগী সত্তা হতে পারো, তবে ঈশ্বরকে জানিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নাও। কিন্তু সে সম্ভাবনা না থাকলে ফিরে আসো বন্ধু।”

 

৮২ 

ব্যারিষ্টার জমির উদ্দীন সরকার 

 

তিনি দুই দফা বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের স্পীকার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। অধিকন্তু,  তিনি দুইবার বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পেশায় আইনজীবি। আওয়ামী মুসলিমের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সহচর হিসাবে সুপরিচিত ছিলেন। ১৯৭৫ পরবর্তীকালে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক ধারার প্রবর্তন হলে ঢুকে পড়েন সেই দলে। তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল— বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন এডহক কমিটির সদস্য । বর্তমানে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রথম সারির নেতা।  স্থায়ী কমিটির সদস্য।

দেশের এক আলোচিত বিচারক শামসুর রহমান এর রিয়েলিটি শো চলত একদা। জাতীয় গণমাধ্যম বিটিভিতে প্রচার হত। তিনি চোখ বন্ধ করে বাদী ও বিবাদীর গল্প শুনিয়ে মজার এক শো করতেন। উদাহরণ রাখতে দুই একটা নাম ব্যবহার করতেন। করিম, জমির প্রমুখের নাম। কাজেই জমির উদ্দীন বললে দেশবাসীর কেহ না চিনলেও যখনই নামটা জমিরউদ্দীন সরকার, আরেকটু বড় করলে নামের আগে ব্যারিষ্টার জুড়ে দিলেই জানা যায় ব্যারিষ্টার জমিরউদ্দীন সরকার একজনাই হতে পেরেছেন। তিনি রাজনীতি করে যে সম্মান পেয়েছেন নিজ দল থেকে তা অনেকের ভাগ্যে জুটে না। দায়িত্ব পাবার এমন ঐতিহাসিক জায়গা থেকে তিনি ইতিহাসের পাতায় এক আলোচিত নাম হয়েই রইবেন।

জমিরউদ্দিন সরকার ১৯৩১ সালের ১ ডিসেম্বর পঞ্চগড় জেলার তেতুঁলিয়া থানার নয়াবাড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মরহুম মৌলভী মুহম্মদ আজিজ বক্স একজন জোতদার ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ও এলএলবি পাশ করেন। পরে লন্ডনের লিংকনস ইন থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করে এসে ঢাকা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। তিনি এক কন্যা ও দুই পুত্রের জনক।

জনাব জমির চার বার জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয়, ১৯৯১ সালের পঞ্চম ও ১৯৯৬ সালের সপ্তম সংসদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। বিএনপি সরকারের আমলে তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি( ২০০৪ পরবর্তী)  হিসেবেও বেশ কিছু দিন দায়িত্ব পালন করেন। রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী পদত্যাগ করার পর নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত সংবিধান অনুযায়ী স্পিকার ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

বিএনপি সরকারে তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮০-৮২ সময়কালে তিনি প্রথমে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত এবং পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১-৯৬ সময়কালে তিনি ভূমি, শিক্ষা এবং আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনের পর গঠিত স্বল্পকালীন বিএনপি সরকারে তিনি আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

এদিকে ১৯৪৫ সালে ছাত্র থাকা অবস্থায় তৎকালীন ছাত্র ফেডারেশনের মাধ্যমে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। পরে তিনি ছাত্র ইউনিয়ন ও ন্যাপের সমর্থক ছিলেন। ১৯৭১ সালে হাইকোর্টে আইনজীবীদের যে গ্রুপটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে জমিরউদ্দিন সরকার ছিলেন তাদের একজন। আইন পেশায় সুনাম ও খ্যাতি অর্জন করায়   জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত তাকে পাঁচবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে পাঠান। দল গঠনের প্রথম পর্যায়ে জিয়াউর রহমান জাগদল গঠন করলে তিনি তাতে যোগ দেন। তিনি ছিলেন জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল বা জাগদল-এর ওয়ার্কিং কমিটির প্রথম সারির সদস্য। পরে বিএনপি প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি এর স্থায়ী কমিটির সদস্য হন।

গত চার দশকে ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা ও লাতিন আমেরিকার বহ দেশ সফর করেছেন এবং আন্তর্জাতিক বহু আইন সম্মেলন ও সেমিনারে সভাপতিত্ব করেছেন। তিনি লেখক হিসাবেও আদৃত নাম।

একজন জমিরউদ্দীন সরকারের নেতৃত্ব, দক্ষতা এবং বৈশ্বিক রাজনীতির জ্ঞান, তাঁকে জাতীয়তাবাদী বলয়ে অভিভাবকশ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করায়। তাঁর জীবদ্দশায়  রাষ্ট্রীয় গুরু দায়িত্ব পাওয়া এবং নিজকে ক্লিন ইমেজের রাজনীতিক হিসাবে ধরে রাখার কারণে তিনিও রাজনৈতিক ইতিহাসে উজ্জ্বল একটি নক্ষত্রের মত করেই বিচরণ করছেন বা করবেন বলে অনুমিত হয়।

 

৮১ 

রাশেদ খান মেনন 

এক নজরেঃ 

জন্ম : ১৮ মে, ১৯৪৩, পিতার কর্মস্থল ফরিদপুরে। পিতা : মরহুম স্পীকার বিচারপতি আব্দুল জববার খান।মাতা : মরহুমা সালেহা খাতুন। পিতৃভূমি : গ্রামঃ বাহেরচর-ক্ষুদ্রকাঠি, উপজেলাঃ বাবুগঞ্জ, বরিশাল। শিক্ষা : বিএ (অনার্স), এমএ (অর্থনীতি), এসএম হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। গবেষণা : খাদ্য নিরাপত্তা, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা, ভূমি আইনের সংস্কারসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক ইস্যুতে গবেষণা কাজ ও জাতীয় দৈনিক ও সাপ্তাহিকে নিয়মিত কলাম লেখা ও প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা।

বাংলাদেশের একজন বামপন্থী সংশোধনবাদী ধারার রাজনৈতিক নেতা তিনি। ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে তিনি প্রথমবারের মতো জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির নির্বাচিত সভাপতি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারী নির্বাচনের জন্য গঠিত সর্বদলীয় মন্ত্রী সভায় ডাক ও তার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। এই নির্বাচনে তিনি ঢাকা থেকে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। ২০১৮ সালে তিনি পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে থাকেন। তিনি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ছিলেন। তিনি চীনপন্থী রাজনীতিতে দীক্ষিত এবং মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ভাবশিষ্য। ষাটের দশকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক আইন বিরোধী ও পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন। ১৯৬২-র শিক্ষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান সংগঠনে তিনি অসামান্য ভূমিকা পালন করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেন। পাকিস্তান আমলে “স্বাধীন পূর্ব বাংলার” কথা বলার জন্য তাকে সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়েছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তিনি বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং তাকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মনোনীত করা হয়। ২০০৮-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। 

সুপ্রসিদ্ধ পারিবারিক ঐতিহ্যের অধিকারী রাশেদ খান মেনন-এর ভাইদের মধ্যে রয়েছেন স্বনামধন্য কলামিষ্ট প্রয়াত সাদেক খান; সাবেক মন্ত্রী, সচিব ও রাষ্ট্রদূত কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ; সাবেক মন্ত্রী প্রখ্যাত সাংবাদিক এনায়েতুল্লাহ খান; সাবেক সংস্কৃতিক প্রতিমন্ত্রী বেগম সেলিমা রহমান; মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক শহীদুল্লাহ খান ও প্রবাসী স্থপতি সুলতান মাহমুদ খান (আমেরিকা); প্রসিদ্ধ ফটোগ্রাফার এলেন খান (অস্ট্রেলিয়া) ও ইসলামি চিন্তাবিদ আমানুল্লাহ খান (অস্ট্রেলিয়া)। স্ত্রী লুৎফুন নেসা খান অবসর প্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা। কন্যা ড. সুবর্ণা খান ক্যান্সার সেলের ওপর পিএইচডি করে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত। পুত্র আনিক রাশেদ খান, ইউনিভাসির্টি অব লন্ডন থেকে আইন বিভাগে অধ্যায়ন করেছেন।

ঐতিহ্যবাহী ছাত্র আন্দোলন  ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান

ষাটের দশকের তুখোড় ছাত্রনেতা রাশেদ খান মেনন বাষট্টির আয়ুববিরোধী সামরিক শাসন ও শিক্ষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে আসেন। ১৯৬৩-৬৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)-এর সহ-সভাপতি (ভিপি) ও ’৬৪-৬৭ সালে পূর্বপাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন। বাষট্টি সালে নিরাপত্তা আইনে প্রথম কারাবন্দী হওয়ার পর ’৬৯ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময় ও বিভিন্ন মেয়াদে নিরাপত্তা আইন, দেশরক্ষা আইন ও বিভিন্ন মামলায় কারাবরণ করেন। ’৬৪-এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধে ছাত্র সমাজের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সমাবর্তন অনুষ্ঠানে  মোনেম খানের আগমনকে বিরোধীতা করতে গিয়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন ও পরে সুপ্রীম কোর্টের রায়ে ঐ বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার হলে জেল থেকে এম.এ পরীক্ষা দেন। ’৬৭-৬৯ জেলে থাকাকালীন অবস্থায় তিনি বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসেন এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তিনি ক্যান্টনমেন্টে নীত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত জেলের বাইরে তার যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে কাজ করেন।

 

ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পর জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন কৃষক সমিতিতে যোগ দেন ও সন্তোষে ঐতিহাসিক কৃষক সম্মেলনের সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭০-এর বাইশে ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানের জনসভায় ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা’ কায়েমের দাবি করায় এহিয়ার সামরিক সরকার তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে ও তার অনুপস্থিতিতে সামরিক আদালতে সাত বছর সশ্রম কারাবাস ও সম্পত্তির ষাট ভাগ বাজেয়াপ্তর দন্ডাদেশ প্রদান করে। তিনি তখন আত্মগোপন করে স্বাধীনতার লক্ষ্যে কৃষকদের সংগঠন গড়ে তোলার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন।

 

মুক্তিযুদ্ধ

’৭১-এর মার্চে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে তিনি কার্যত প্রকাশ্যে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগঠিত করার কাজ শুরু করেন পঁচিশে মার্চ পল্টনের শেষ জনসভায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহবান জানান।

পঁচিশে মার্চের কালরাতের গণহত্যার পর তিনি আর এক মুহূর্ত দেরী না করে ঢাকার অদূরে নরসিংদীর শিবপুরকে কেন্দ্র করে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের কাজ শুরু করেন এবং পরে ভারতে গিয়ে সকল বামপন্থী সংগঠনকে নিয়ে ‘জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ সমন্বয় কমিটি’ গঠন করে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করে প্রবাসী সরকারের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন ও মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন সেক্টরে এবং দেশের অভ্যন্তরে কেন্দ্র স্থাপন করে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।

 

স্বাধীনতা উত্তর রাজনীতি

স্বাধীনতা উত্তরকালে রাশেদ খান মেনন বিভক্ত কমিউনিস্ট গ্রুপগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (লেনিনবাদী) গঠন করেন এবং নিজে ভাসানী ন্যাপ-এর প্রচার সম্পাদক ও কৃষক সমিতির দপ্তর সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। ১৯৭৩-এ ন্যাপ (ভাসানী)-এর প্রার্থী হিসেবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বরিশাল থেকে দু’টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।

 

১৯৭৪-এ ভাসানী ন্যাপ থেকে বেরিয়ে এসে ইউনাইটেড পিপলস পার্টি (ইউপিপি) গঠিত হলে তার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। কিন্তু ১৯৭৮-এ ইউপিপি সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমানের জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টে যোগ দিলে রাশেদ খান মেনন ইউপিপি ত্যাগ করে গণতান্ত্রিক আন্দোলন গঠন করেন এবং ১৯৭৯ সনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এ সময় ওয়ার্কার্স পার্টি নামে পার্টি পুনঃসংগঠিত হয় এবং রাশেদ খান মেনন ওয়ার্কার্স পার্টির সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য হন।

২০০৮ সালের নির্বাচনে তিনি ঢাকা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। নবম সংসদে তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও কার্যউপদেষ্টা কমিটির সদস্য ছিলেন। এছাড়া সংবিধান সংশোধন বিশেষ কমিটির সদস্য হিসাবে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী প্রণয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। আদিবাসী সংসদীয় ককাসের তিনি সভাপতি ছিলেন। ২০১৪ এর ৫ ই জানুয়ারী নির্বাচনের জন্য গঠিত সর্বদলীয় মন্ত্রী সভার তিনি সদস্য ছিলেন।  ডাক ও তার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। ঐ নির্বাচনে তিনি ঢাকা থেকে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। পান এক পর্যায়ে সমাজ কল্যান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও।  রাজনৈতিক কর্মকান্ড ছাড়াও গবেষণার কাজ, প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা, বিশেষ করে জাতীয় দৈনিকসমূহে তার নিয়মিত কলাম লেখায় তিনি নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। তার ঐ কলামসমূহ একত্রিত করে এ পর্যন্ত পাঁচটি বই প্রকাশিত হয়েছে।

জনাব মেননের রাজনৈতিক জীবন সমৃদ্ধির। কখনো বাম ধারার একঘেয়ে রাজনীতির মধ্যে না থেকে চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন। কখনো, এই তিনি শ্রেণি সংগ্রামের লড়াই করছেন, প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার আন্দোলনে রয়েছেন, আবার তিনিই ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে যেয়ে কৌশলে প্রবেশ করে দায়িত্ব লুফে নিয়েছেন। মেনন এর ওপর গুলি বর্ষণের ঘটনাও আলোচিত পর্যায়ের। অল্পের জন্য তিনি বেঁচে যান। মেনন আছেন, হয়তো প্রজন্ম তাঁকে মনেও রাখবে। নেতৃত্বের নানা গুনাবলী তাঁর রক্তে প্রবাহিত, যেখানে তিনি নিজেকে অন্য দশজনের চেয়ে আলাদা করতে পেরেছেন।

 

 

সুপ্রিয় পাঠক,

বাংলাদেশের সর্বযুগের সেরা রাজনীতিকদের তালিকা( ১০০) প্রকাশে কেএইচএন রিসার্চ টিম কাজ করে যাচ্ছে। পরবর্তী প্রতিবেদনে ৮০ হতে ৭৬ নং তালিকায় যারা থাকছেন, তা প্রকাশ করা হবে। সে পর্যন্ত আমাদের সাথেই থাকুন।

 

আপনাদের মতামত এবং জায়গা পাওয়া  কারো সম্পর্কে তথ্য দিতে চাইলে নিম্নলিখিত ই মেইলে পাঠান।

 

 

5 Comments

  1. Alex TM
    April 1, 2015 at 20:27
    Reply

    Dolorum nascetur quibusdam bibendum nesciunt torquent vehicula, nostra? Nisl? Excepteur repellat provident, laboriosam! Nullam vel.

    • Alex TM
      April 1, 2015 at 20:28
      Reply

      Corporis quasi dicta voluptates, rerum vero eos quaerat, quo aliqua voluptates suspendisse quod tempus! Interdum.

      • Alex TM
        April 1, 2015 at 20:28
        Reply

        Egestas molestias erat impedit blanditiis quam, proident rutrum iste? Illum? Aenean proin. Nostrum pretium, commodi.

Leave a Reply

Close
Close