Blog

কামরুল হাসান নাসিম
প্রধান গবেষণা কর্মী
কেএইচএন রিসার্চ টিম 
ল্যাটিন আমেরিকা ও আফ্রিকা মহাদেশে বিশ্বব্যাংকের ব্যর্থতার ফলে ১৯৮৯ সালে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক সুশাসনের ধারণাটি উদ্ভব হয়। এটি বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপশন নামে পরিচিত।
 
‘সুশাসন’ একটি অংশগ্রহণমূলক শাসন ব্যবস্থা। তাই আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ‘সুশাসন’ শব্দটি ব্যাপকভাবে আলচিত হয়। আধুনিক বিশ্বে এর গুরুত্ব উপলব্ধি করে ১৯৯৫ সালে ADB এবং ১৯৯৮ সালে IDA সুশাসনের উপর প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সকল জটিলতা ও প্রতিবন্ধকতাকে কাটিয়ে সর্বাধিক জনকল্যাণ সাধনই এর প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
 
সুশাসন কী?
গুড গভর্ন্যান্স (Good Governance ) বা সুশাসনের জন্য দরকার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা। ডিজিটাল ব্যবস্থা প্রচলনের ফলে সরকারি ব্যবস্থাসমূহকে আধুনিক ও যুগােপযোগী করার পাশাপাশি সরকারি ব্যবস্থাসমূহের সবচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সম্ভব। এর ফলে নাগরিকের হয়রানি ও বিড়ম্বনার অবসান ঘটে এবং দেশে সুশাসনের পথ নিষ্কণ্টক হয়। শাসন ব্যবস্থায় ও প্রক্রিয়ায় ইলেকট্রনিক বা ডিজিটাল পদ্ধতির প্রয়োগই হচ্ছে ই-গভর্ন্যান্স।
 
সুশাসনের গুরুত্বঃ
‘সুশাসন’ একটি দ্বিমুখী প্রত্যয়। প্লেটোর ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে প্রথম এর ধারণা পাওয়া যায়। এখানে এক পক্ষ জনগণ ও অন্য পক্ষ সরকার। এটি নাগরিকদেরকে তাদের অধিকার ভোগ করার নিশ্চয়তা প্রদান করে। তাই সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে নাগরিকগণ আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ও অধিকার ভোগ করতে পারে। সুশাসন হচ্ছে এমন এক ব্যবস্থা যার মাধ্যমে শাসক-শাসিতের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠে। আর এই প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জাতীয় জীবনে সমৃদ্ধি আনায়ন করে।আর এর গুরুত্ব উপলব্ধি করে আশির দশকের দ্বিতীয়ার্ধে বিশ্বব্যাংক সুশাসনকে উন্নয়নের এজেন্ডাভুক্ত করে। এতে সরকার ও জনগনের অংশগ্রহন নিশ্চিত হয় ও উভয়েই লাভবান হয় বলে সুশাসনকে সরকার ও জনগনের ‘Win Win Game’ বলা হয়। আইএমএফ এর মতে,’ দেশের উন্নয়নে প্রতিটি স্তরের জন্য সুশাসন আবশ্যক।’ তবে সুশাসনের এই তাৎপর্য গ্রামীণ সাধারণ মানুষের নিকট অজানা।
 
জাতিসংঘের মতে, ‘সুশাসনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হল মৌলিক স্বাধীনতার উন্নয়ন।’
 
UNDP এর মতে,’সুশাসন সকলের অংশগ্রহনের মাধ্যমে অর্থপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করে।’
 
অন্যদিকে,জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের মতে,’”Good governence is perhaps the single most important factor in eradicating proverty and promoting development।”
 
ম্যাককরনির মতে, ‘সুশাসন বলতে রাষ্ট্রের সাথে সুশীল সমাজের, সরকারের সাথে জনগনের, শাসকের সাথে শাসিতের সম্পর্ককে বোঝায়।’
 
সুশাসনের বৈশিষ্ট/সুশাসন প্রতিষ্ঠার শর্তগুলো
আইনের শাসন
মানবাধিকার সংরক্ষণ
শাসন ব্যবস্থায় স্বছতা
প্রশাসনিক কার্যক্রমে জবাবদিহিতা
সকলক্ষেত্রে সমতা
সকলের প্রতি ন্যায়পরায়ণতা
জনগণের মতামতের প্রতিশ্রদ্ধাবোধ
জাতীয় শুদ্ধাচার
 
সুশাসন ও বাংলাদেশ
Milon | Posted on: Jun 24, 2018 |Updated: Feb 2, 2020| Category: নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সু-শাসন |
সুশাসন ও বাংলাদেশের সংবিধানঃ
 
আধুনিক রাষ্ট্রসমূহ কল্যানমূখী। আর রাষ্ট্রকে কল্যাণমূখী করতে সুশাসন বাস্তবায়নের কোন বিকল্প নেই। সুশাসন বাস্তবায়নে বাংলাদেশের সংবিধানে বেশকিছু অনুচ্ছেদ সন্নিবেশিত হয়েছে।
 
অনুচ্ছেদ ১১- এখানে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। যেহেতু গণতন্ত্র হল সুশাসনের প্রাণ। তাই বলা যায়, এই অনুচ্ছেদে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের স্বীকৃতির মাধ্যমে রাষ্ট্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে।
 
অনুচ্ছেদ ৫৯ ও ৬০- এই দুই অনুচ্ছেদে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠা (৫৯ অনুচ্ছেদ) ও এর ক্ষমতা (৬০ অনুচ্ছেদ) সম্পর্কে বলা হয়েছে। যেহেতু গণতন্ত্র মানেই জণগনের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ এনং স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা জণগনের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ নিশ্চিতের নিশ্চয়তা প্রদান করে। তাই বলা যায় এই দুই অনুচ্ছেদের মাধ্যমে সুশাসনের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে।
 
অনুচ্ছেদ ৭৭- এই অনুচ্ছেদে সরকারি কর্মচারিদের দুর্নীতি প্রতিরোধ করার ব্যবস্থা হিসেবে ন্যায়পাল (Ombudsman) এর বিধান যুক্ত করা হয়েছে।ন্যায়পাল তার উপর অর্পিত ক্ষমতা বলে সরকারের যেকোন সংস্থার কার্যাবলি তদন্ত করার ক্ষমতা রাখেন। ১৮০৯ সালে সুইডেনে সর্বপ্রথম ন্যায়পালের বিধান জারি করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৮০ সালে বাংলাদেশের সংবিধানে এই বিধান যুক্ত করা হয়।তবে এটি এখন পর্যন্ত কার্যকর করা হয় নি।
 
 
এছাড়া সংবিধানে তৃতীয় ভাগে (অনুচ্ছেদ ২৬-৪৭) নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে এবং অষ্টম ভাগে ( অনুচ্ছেদ১২৭-১৩২) সরকারি অর্থের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের জন্য মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের বিধান যুক্ত করা হয়েছে।
 
সুতরাং বলা যায়,দেশে সুশাসন বাস্তবায়নের সকল প্রকার সাংবিধানিক নিশ্চয়তা(Constitutional guarantee) আমাদের সংবিধানে সন্নিবেশিত হয়েছে হয়েছে।
বাংলাদেশে সুশাসনের অবস্থা
নির্বাহী নিয়ন্ত্রণঃ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রায় ১৬ বছর রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন বিদ্যমান ছিল। তারপর যখন সংসদীয় সরকার পদ্ধতি ফিরে আসল তখন, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী Floor Crossing সমস্যা এখনও রয়ে গেছে। যা সুশাসনের অন্তরায়।
 
 
আইন প্রণয়নে সমস্যাঃ বর্তমানে আইন প্রণয়নে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, বিরোধীদল নিপীড়ন, মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করা ইত্যাদি বিষয়গুলো চলে আসে। তাছাড়া আইন প্রণয়নে বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় না আসা, টেকনিক্যাল বিষয়গুলো খোলামেলা আলোচনা না হওয়া, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গে সম্পৃক্ত না করার মত ঘটনা ও ঘটে।
রাজনৈতিক জবাবদিহিতাঃ নির্বাচিত হলে প্রতিনিধিরা যেন জনগণ তো ছাড়, সময় সময় আইনের ও ঊর্ধে চলে যান। আর নির্বাচন যদি সুষ্ঠু না হয় তো ‘জবাবদিহিতা’ নামক কোন শব্দই যে তাঁদের অভিধানে থাকবে না, তা খুবই ন্যায়সঙ্গত।
 
এছাড়া নিম্নোক্ত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করার প্রয়াস পাওয়া যায়।
আমলাতান্ত্রিক কাঠামো ও জটিলতাঃ
স্থানীয় সরকার কাঠামোঃ
স্বাধীন এবং দক্ষ বিচার ব্যবস্থাঃ
মতপ্রকাশের স্বাধীনতাঃ
রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্নীতিঃ
পুলিশ ও প্রশাসনকে রাজনীতিকরণঃ
নিয়োগ ও সরকারি কাজে দলীয় লোকঃ
দুর্নীতি দমন কমিশনের অকার্যকারিতাঃ
প্রশাসন সহ রাষ্ট্রীয় সকল প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক প্রভাব।
 
আজকাল সব মহলেই উন্নয়ন উন্নয়ন বলে নানা কথা শোনা যাচ্ছে, যদিও খুব স্পষ্ট নয় এই কথা বলে তারা ঠিক কী বোঝাতে চায়। একদল লোক, তাঁদের মধ্যে রাজনীতিক রয়েছেন, পেশাদার কলম লিখিয়েও রয়েছেন, উন্নয়ন মানে প্রবৃদ্ধি, সে কথা বোঝাতে বিস্তর কসরত করছেন। কিন্তু শুধু প্রবৃদ্ধি যথেষ্ট নয়, প্রবৃদ্ধির সুষম বণ্টনও গুরুত্বপূর্ণ, সে কথাও কেউ কেউ বলছেন। এই দুই পক্ষের তর্ক-বিতর্ক থেকেই হোক বা অন্য কোনো কারণে, একটা বিষয়ে মোটামুটি ঐকমত্য রয়েছে যে সুশাসন ছাড়া প্রকৃত উন্নয়ন যেমন সম্ভব নয়, তেমনি সম্ভব নয় সে উন্নয়নের সুফল কমবেশি সবার কাছে অর্থপূর্ণভাবে পৌঁছে দেওয়া।
 
সম্প্রতি অর্থনীতিবিদ নজরুল ইসলাম গভর্নেন্স ফর ডেভেলপমেন্ট বা উন্নয়নের জন্য সুশাসন—এই নামে একটি বই লিখেছেন (পলগ্রেভ ম্যাকমিলান, নিউইয়র্ক ২০১৬)। এই গ্রন্থে জাতিসংঘে কর্মরত এই অর্থনীতিবিদের মোদ্দা বক্তব্য, উন্নয়নের অধিকাংশ সূচকের নিক্তিতে বাংলাদেশ গেল কয়েক দশকে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন অর্জন করেছে, কিন্তু এই উন্নয়নকে আরও কয়েক কদম এগিয়ে নেওয়া সম্ভব, তার সুফল সবার কাছে পৌঁছে দেওয়াও সম্ভব, যদি সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ আরও একটু মনোযোগী হয়। আর সে জন্য দরকার গোটা কয়েক কাঠামোগত পরিবর্তন।
 
সুশাসনের দুটো দিক, তার একদিকে দেশের মানুষ, যারা সে দেশের প্রকৃত মালিক। অন্যদিকে সরকার ও আমলাতন্ত্র, যারা দেশের মানুষের নামে সে দেশ শাসন করে। সরকার ও আমলাতন্ত্র যদি দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করে, তাহলে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সমস্যা বাধে যখন এই দুইয়ের মধ্যে ব্যবধান জন্মে, তাদের মধ্যে দেখা দেয় বিরোধ। আর এই বিরোধের কারণটা খুব সোজা। সরকার, তা নির্বাচিত বা ওপর থেকে জুড়ে বসা হোক, যখন দেশের মানুষের স্বার্থ বিবেচনা না করে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত থাকে, তখন প্রতিবাদ ওঠে দেশের মানুষের কাছ থেকে। ফলে দেখা দেয় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, যার ঢেউ এসে লাগে অর্থনীতিতে, বিঘ্নিত হয় দেশের মানুষের দৈনন্দিন জীবনচারিতা।
 
সুশাসন ব্যাপারটা শুনতে বেশ বায়বীয় মনে হলেও বস্তুত তা নির্ণয়যোগ্য একটি ধারণা। আমাদের দেশ খুব সুশাসিত, সে কথা বললেই হবে না, তা মেপে ও ওজন করে দেখতে হবে। আর সে কাজটা করা খুব কঠিন এমন কিছু নয়। পণ্ডিতদের সূত্র অনুসরণ করে নজরুল ইসলাম সুশাসনের মোট ছয়টি সূচক বা ইন্ডিকেটর চিহ্নিত করেছেন। সেগুলো হলো দায়বদ্ধতা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সহিংসতার অনুপস্থিতি, সরকারের কার্যকারিতা, নিয়মবিধির প্রায়োগিকতা, আইনের শাসন এবং দুর্নীতির নিয়ন্ত্রণ। সুনির্দিষ্ট উপাত্ত-ভিত্তির ব্যবহারের মাধ্যমে এই সূচকের প্রতিটির গুণাগুণ আমরা খুবই বৈজ্ঞানিকভাবে নির্ণয় করতে পারি। এই পদ্ধতির ভিত্তিতেই কোন দেশ কতটা দুর্নীতিপরায়ণ বা কোন দেশ কতটা মুক্ত, তার বছরওয়ারি হিসাব চালু হয়েছে, যার সঙ্গে আমাদের তিক্ত-মধুর সম্পর্ক রয়েছে।
 
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা যদি এই ছয়টি সূচকের ব্যবহার করি, তাহলে ফল কী দাঁড়ায়? নজরুল প্রধানত বিশ্বব্যাংকের উপাত্ত ব্যবহার করে ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন চার্ট প্রস্তুত করেছেন, দেখা যাচ্ছে তার অধিকাংশেই বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বা শিল্পোন্নত দেশগুলোর চেয়ে লক্ষণীয়ভাবে পিছিয়ে রয়েছে। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের চেয়েও বাংলাদেশের সুশাসন পরিস্থিতি নেতিবাচক। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ, নিয়মবিধির প্রতিপালন ও আইনের শাসন, এই সূচকসমূহে বাংলাদেশ এই গ্রুপের সবার নিচে। সরকারের কার্যকারিতার প্রশ্নে বাংলাদেশ নেপালের চেয়ে সামান্য ওপরে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রশ্নে বাংলাদেশ তার দুই প্রতিবেশী নেপাল ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে। এক দায়বদ্ধতার প্রশ্নেই বাংলাদেশ ভারত ছাড়া বাকি সার্কভুক্ত দেশ থেকে এগিয়ে।যে প্রবৃদ্ধি নিয়ে আমাদের এত কথা, সেখানেও কিন্তু আমরা পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহ বা ভারত থেকে পিছিয়ে। নজরুল জানাচ্ছেন, ১৯৮১-২০১০ এই সময়কালে বাংলাদেশের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার গড়ে ৪ দশমিক ৮ শতাংশ। এর পরের বছরগুলোতে অবশ্য বাংলাদেশ ৬ শতাংশ বা তার চেয়েও অধিক বার্ষিক হারে প্রবৃদ্ধি অর্জনে সক্ষম হয়েছে।
 
কিন্তু বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির আবক্রপথ বা ট্রাজেকটরি যে সর্বদা ঊর্ধ্বমুখী, তা নয়। অনেক সময় তাকে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে, মূলত রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি-পথ যে মোটেই ঋজু নয়, সে কথা আরও স্পষ্ট হয় যখন একই সময়ে অন্যান্য দেশ বা গ্রুপ কোনো আবক্রপথ ধরে চলেছে, তার একটা তুলনামূলক হিসাব নেই। ১৯৬১-১৯৮০ সালের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার গড় বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ শতাংশ। ১৯৮৪-২০১২ সময়কালে চীনের অর্থনীতি বৃদ্ধি পেয়েছে ১০ শতাংশেরও অধিক হারে। প্রতিবেশী ভারতে ১৯৯১-২০১০ সালের মধ্যে বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৮ শতাংশ।
 
আমরা যদি সুশাসনের ভিতটি অর্থাৎ নজরুল যে ছয়টি সূচক চিহ্নিত করেছেন, তা আরও খানিকটা মজবুত করতে পারতাম, তার ফল হতো দুই রকম। প্রথমত, আইনের শাসনের অভাব বা দুর্নীতি আমাদের প্রতিদিন নানাভাবে আক্রান্ত করে, জীবনের মানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই দুই খাতে পরিবর্তন অর্জিত হলে নাগরিক জীবন কিছুটা হলেও দুর্ভাবনামুক্ত হতো। অন্যদিকে দায়বদ্ধতা বাড়লে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জিত হলে, সহিংসতা ঠেকানো গেলে বা সরকারের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পেলে অর্থনীতি অনেক বেশি স্থিতিশীল ভিত্তির ওপর স্থাপিত হয়, তার আবক্রপথ অনেক বেশি আস্থাপূর্ণ হয়। অর্থনীতিকে স্থিতিশীল ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো সম্ভব হলে নাগরিক জীবনে অধিক স্বস্তি আসে, ভবিষ্যৎ নিয়ে তাদের ক্রমবর্ধমান আস্থা জন্মে।অতএব উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে, কিন্তু কীভাবে? এ ব্যাপারে নজরুল ইসলাম একটি ব্যবস্থাপত্র নির্দেশ করেছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা সামলানোর জন্য নজরুল সরকারের মেয়াদ পাঁচ থেকে কমিয়ে চারে আনার প্রস্তাব করেছেন। তাঁর যুক্তি, সরকারের মেয়াদ কম হলে হরতাল বা সহিংস রাজনীতির প্রবণতা কিছুটা হলেও কমবে। পাশাপাশি তিনি বর্তমানের নির্বাচন পদ্ধতি বদলিয়ে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের প্রস্তাব করেছেন। মোট ভোটের ৪০ শতাংশ বা তার চেয়েও কম পেয়ে বাংলাদেশে গত পাঁচটি নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়েছে। তাঁর বিশ্বাস, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব অর্জিত হলে একদিকে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভিত্তি যেমন জোরদার হবে, তেমনি এখন যাঁরা রাজনৈতিক ক্ষমতা বলয়ের বাইরে রয়ে যাচ্ছেন, তাঁরা প্রতিনিধিত্বের সুযোগ পাবেন।
 
 
সুশাসনের একটি লক্ষ্য দুর্নীতিমুক্ত ব্যবস্থা গড়ে তোলা। দুর্নীতি বলতে আমরা অনেক সময় নাগরিক জীবনে ব্যক্তিগতভাবে কী সংকটের মুখে পড়ি, সে বিবেচনাতেই সীমাবদ্ধ থাকি। অথচ দুর্নীতির ফলে আসল ক্ষতি হয় পুরো দেশের, বিশেষত যখন রাজনৈতিক নীতিনির্ধারকেরা আমলাতন্ত্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেশের স্বার্থবিরোধী নীতি বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বাংলাদেশে এটা কত বড় সমস্যা নজরুল তার গোটা কয়েক উদাহরণ দিয়েছেন। যেমন নিজস্ব ক্ষমতাভিত্তিক উদ্যোগের বদলে বিদেশি কোম্পানিভিত্তিক ব্যবস্থাপনায় বিদ্যুৎ খাত ছেড়ে দেওয়া। এর ফলে নিজস্ব উৎস থেকে জ্বালানি সংগ্রহের যে উদ্যোগ বাংলাদেশ নিতে পারত, তা কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে।‘সু’ উপসর্গযোগে ‘সুশাসন’ শব্দটি গঠিত হয়েছে। ‘সু’ অর্থ হলো ভালো, উত্তম, উৎকৃষ্ট, সুন্দর, মধুর, শুভ ইত্যাদি। আর ‘সুশাসন’ হলো ন্যায়নীতি অনুসারে উত্তমরূপে সুষ্ঠুভাবে ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেশ বা রাষ্ট্র শাসন। সুশাসন হলো একটি কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রতিফলন। সময়ের প্রয়োজনে এবং শাসক ও শাসিতের সম্পর্কের ভিত্তিতে কোনো দেশের শাসন পদ্ধতির বিবর্তন হয়ে থাকে। শাসিতের কাম্য শুধু শাসন নয়, সুশৃঙ্খল ও নিয়মতান্ত্রিক শাসন- যাকে আমরা সুশাসন বলতে পারি। কোনো দেশে সুশাসন আছে কিনা তা বোঝার জন্য প্রথমে দেখতে হবে সে দেশে শাসকের বা সরকারের জবাবদিহিতা আছে কি-না এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশে দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনিক স্বচ্ছতা আছে কি-না।
 
সুশাসন একটি রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থাকে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নের চরম শিখরে পৌঁছে দেয়। সুশাসনকে এক প্রকার মানদণ্ডও বলা যায় যে মানদণ্ডের সাহায্যে একটি রাষ্ট্র বা সমাজের সামগ্রিক অবস্থা যাচাই করা যায়। যে রাষ্ট্র বা সমাজ যত বেশি সুশাসন দ্বারা পরিচালিত হয় সেই রাষ্ট্র বা সমাজ ততো বেশি অগ্রগতির দিকে ধাবিত হয়।
একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সুশাসনের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘সুশাসন হলো একটি দেশের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সম্পদের কার্যকরী ব্যবস্থা, তবে ব্যবস্থাটি হবে উন্মুক্ত, স্বচ্ছ জবাবদিহিতামূলক ও ন্যায্য সমতাপূর্ণ।’
 
 
বিশ্বব্যাংকের ধারণাসূত্রে সুশাসন নিম্নে বর্ণিত বিষয়গুলো নিশ্চিত করে- ১. সরকারি কাজে দক্ষতা, ২. স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, ৩. বৈধ চুক্তির প্রয়োগ, ৪. জবাবদিহিমূলক প্রশাসন, ৫. স্বাধীন সরকারি নিরীক্ষক, ৬. প্রতিনিধিত্বমূলক আইনসভার কাছে দায়বদ্ধতা, ৭. আইন ও মানবাধিকার সংরক্ষণ, ৮. বহুমুখী সাংগঠনিক কাঠামো ৯. গণমাধ্যমর স্বাধীনতা।
 
অপরপক্ষে, পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ সুশাসন বলতে গণতান্ত্রিক শাসন ও গণতান্ত্রিক সরকারকে বুঝিয়েছেন। তারা সুশাসনের চারটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন। এগুলো হলো-
 
সুশাসন হলো অধিকতর রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে শাসনব্যবস্থা পরিচালনা।
সুশাসন অবশ্যই আইনের শাসনের ওপর প্রতিষ্ঠিত।
রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।
প্রশাসনিক দক্ষতা ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হবে শাসন কাঠামোর অন্যতম দিক।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী পিয়েরে ল্যান্ডের মিলস এবং ইসমাইল সেরাজেলডিন সুশাসনের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, ‘জনগণের সুষ্ঠু চাহিদা, ন্যায্য অধিকার উপভোগের নিশ্চয়তা প্রদানের লক্ষ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা চর্চার মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার প্রক্রিয়াই হলো সুশাসন।’ বাস্তবিকপক্ষে সুশাসনের বহুবিধ অর্থ উল্লেখ করা হলেও বাস্তবতার নিরিখে একটি দেশের সুশাসন সে দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থার উপর নির্ভরশীল। তবে সকল জাতীয় সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থা সুশাসনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক জবাবদিহিতা, স্বাধীন ও দক্ষ বিচারব্যবস্থা, শক্তিশালী সরকারি প্রতিষ্ঠান, স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। মূলত সুশাসন এমন একটি শাসন প্রক্রিয়া যাতে সমাজের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি এবং রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ডের মধ্যকার সুসমন্বিত মিল বিরাজমান থাকে।
 
উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে সুশাসনের যে সব আবশ্যকীয় উপাদান পাওয়া যায় তা নিম্নরূপ-
 
সরকারের বৈধতা এবং স্থায়িত্বের জন্য জনগণের সম্মতি ও অংশগ্রহণ প্রক্রিয়ার আবশ্যকতা, ২. সরকার ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার কর্মকাণ্ডের দায়িত্বশীলতা, ৩. তথ্যের সহজলভ্যতা, ৪. গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, ৫. সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বচ্ছতা, ৬. সরকারি ও দাপ্তরিক কাজে জননিরীক্ষণ, ৭. দক্ষতা নির্মাণ, ৮. সময়োপযোগী নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, ৯. সুষ্ঠু সেবা প্রদান, ১০. আইনের শাসন ও মানবাধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, ১১. নাগরিকের অধিকার সমুন্নত রাখা ও নিরাপত্তা বিধান, ১২. গণতন্ত্র সমুন্নত রাখা, ১৩. মুক্ত ও বহুভিত্তিক সমাজব্যবস্থা এবং ১৪. বিকেন্দ্রীকৃত ও কার্যকর স্থানীয় শাসন।
 
দেশের মানুষ সরকারের কাছে সর্বনিম্ন খরচ বা বিনিয়োগের মাধ্যমে সর্বোচ্চ ফলাফল প্রত্যাশা করে। সুশাসন তখনই ভালো হয় যখন সরকারের সিদ্ধান্ত ও কর্মগুলো জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণে সহায়ক হয় এবং সরকার জনগণের কাছে তার কর্মের জন্য দায়ী থাকে।
 
সুশাসন আইনের শাসন নিশ্চিত করে। এ ছাড়া এটি রাষ্ট্র বা সমাজে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগণ্যতাকে প্রাধন্য দেয় যা উন্নয়নের ক্ষেত্রে যে সকল সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তাতে দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দেয়। সুশাসন শুধুমাত্র রাষ্ট্র বা সরকার নয়- বেসরকারি খাত এবং সুশীল সমাজকেও গুরুত্ব দেয়। কারণ, রাষ্ট্রের অগ্রগতিতে বেসরকারি খাতের ভূমিকা অনস্বীকার্য এবং সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নির্ধারণে সুশীল সমাজের ভূমিকা অপরিসীম।
সুশাসনের ধারণার প্রেক্ষিতে সুশাসনের যে সব বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায় তা হলো-
 
১. অংশগ্রহণ: জাতি-ধর্ম-বর্ণ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমান অংশগ্রহণ হচ্ছে সুশাসনের প্রধান বৈশিষ্ট্য। অংশগ্রহণ হলো মানবাধিকার। প্রতিনিধি নির্বাচনে সকল নাগরিকের সমান অংশগ্রহণ থাকবে। এক্ষেত্রে প্রতিনিধি নির্বাচনে কোনো কারণে জনগণ বাধাগ্রস্ত হলে তা সুশাসনের অন্তরায় বলে বিবেচিত হবে। যে কোনো রজানৈতিক সংগঠন, ব্যক্তি বা গোষ্ঠী তাদের মতামত প্রকাশ ও দাবি উত্থাপন করার অবাধ অধিকার সংরক্ষণ করবে।
অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রত্যেক নাগরিকের ভোটদান নিশ্চিত করা। সকল নাগরিক অবাধে ও নির্বিঘ্নে ভোটদানে অংশগ্রহণ করবে। এ ধরনের অংশগ্রহণ যেমন গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে, তেমনি রজনৈতিক সমতায়নে সহায়তা করে। এই অংশগ্রহণ হতে হবে সকলের জন্য উন্মুক্ত, অবাধ ও নির্বিঘ্ন। সকলের অধিকার থাকবে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের। অংশগ্রহণ বিভিন্নভাবে নিশ্চিত হতে পারে- যেমন, রাজনৈতিক দল গঠন বা সভা-সমাবেশের মধ্য দিয়ে। এর অর্থ হচ্ছে- সকল নাগরিকের জন্য এ সব রাজনৈতিক কর্মসূচি উন্মুক্ত থাকবে- কখনো কারো দ্বারা বাধাগ্রস্ত হবে না।
 
অংশগ্রহণের একটি বড় উপাদান হচ্ছে- নাগরিকের ক্ষমতায়ন। একজন নাগরিক যখন তার সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা লাভ করে, তখন বোঝা যায় তার ক্ষমতায়ন হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিপক্ষ তার ক্ষমতায়নে বাধা না দিলেই বোঝা যাবে তার ক্ষমাতয়ন নিশ্চিত হয়েছে। নিম্নোক্ত চারটি বিষয় কার্যকর হলে ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হয়- ক. মতামত প্রদানের ক্ষমতা, খ. দক্ষতা, গ. সমস্যা চিহ্নিতকরণ এবং ঘ. বিচার ক্ষমতা।
 
২. আইনের শাসন: সুশাসনের অন্যতম দাবি হলো- একটি স্বচ্ছ আইনি কাঠামো থাকবে এবং এটি প্রতিটি মানুষের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ ‘আইনের চোখে সবাই সমান’- এটি হবে সুশাসনের ভিত্তি। আইনের শাসনের উপস্থিতি ব্যতীত সুশাসন কায়েম হয় না। আইনের শাসনের অর্থ হলো আইনের প্রাধান্য স্বীকার করা এবং আইন মোতাবেক শাসন করা। অধ্যাপক এভি ডাইসি (Professor A.V. Diecy) আইনের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘আইনের শাসনের অর্থ হলো-
 
১. আইনের দৃষ্টিতে সকলেই সমান, ২. সকলের জন্য একই প্রকারের শাসনব্যবস্থা থাকবে, ৩. কাউকে বিনা অপরাধে গ্রেফতার করা যাবে না এবং ৪. বিনাবিচারে কাউকে আটক রাখা যাবে না। এছাড়া অভিন্ন বিচারালয়ের ব্যবস্থাও আইনের শাসনের অন্তর্ভুক্ত। আইনের শাসন যেখানে বর্তমান সেখানে জনগণের স্বাধীনতা বিরাজমান। আইনের শাসনের দ্বারা সাম্য স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব কারণে আইনের শাসন সুশাসনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
 
 
৩. স্বচ্ছতা: স্বচ্ছতা বলতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া এবং সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া পরিপূর্ণ নিয়মতান্ত্রিকভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে কি-না তা বোঝায়। স্বচ্ছতা বলতে তথ্যের অবাধ প্রবাহ এবং তথ্য প্রাপ্তির সহজলভ্যতাকেও বোঝায়। আয়নায় যেমন সব কিছু পরিষ্কার দেখা যায়, স্বচ্ছতাও তদ্রুপ। স্বচ্ছতা বজায় থাকলে দুর্নীতির আশংকা থাকে না এবং নাগরিকদের কোনো প্রকার অন্যায় হয়রানির সম্ভাবনাও থাকে না। তাই সুশাসনের জন্য স্বচ্ছতা একটি বড় উপাদান।
 
৪. সংবেদনশীলতা: নাগরিকদের সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিষ্ঠানকে বেঁধে দেয়া নির্দিষ্ট সময় কাঠামোকে সংবেদনশীলতা বোঝায়। অর্থাৎ যথাসময়ে নাগরিকদের সেবা প্রদান করতে হবে। কোনো প্রকার সময়ক্ষেপণ করে জনভোগান্তির সৃষ্টি করা যাবে না। তাহলে সুশাসনের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে। তাই সংবেদনশীলতা সুশাসনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
 
৫. ঐকমত্যে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে সহযোগিতা: একটি সমাজে বা রাষ্ট্রে বহু ক্রিয়াশীল গোষ্ঠী এবং বহুধা বিভক্ত মতাদর্শের উপস্থিতি বিদ্যমান থাকে। এক্ষেত্রে সুশাসনের দাবি হলো এ ভিন্ন ভিন্ন মত ও স্বার্থের মধ্য থেকে একটি বৃহৎ ঐকমত্যে পৌঁছানো সেখানে পুরো সমাজ বা রাষ্ট্রের প্রধান প্রধান দাবি ও স্বার্থের সমন্বয় ঘটে। ঐকমত্যের বিষয়গুলোকে কিভাবে সফল করা যায় সে সম্পর্কে একটি কর্মপন্থা নির্ধারণ করা জরুরি। এজন্য দরকার একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। যার দ্বারা টেকসই মানব উন্নয়ন সম্ভবপর করা যায় এবং জাতির মধ্যে বিরাজমান দ্বন্দ্বকে হ্রাস করা যায়। এ দায়িত্ব পালনে সরকারের পাশাপাশি বিরোধী দলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। অর্থাৎ সমাজ ও রাষ্ট্রে যত বেশি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হবে সেই সমাজ ও রাষ্ট্রে ততো বেশি সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। যেহেতু সুশাসনের ফল সবাই ভোগ করে তাই সরকার ও বেসরকারি উভয়ের পারস্পরিক সহযোগিতা একান্ত জরুরি।
 
৬. সাম্য: সমাজে বা রাষ্ট্রে প্রত্যেক নাগরিক সমান অধিকার ভোগ করবে। এখানে নারী-পুরুষ, সরকারি-বেসরকারি, আশরাফ-আতরাফ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-গরিব কোনো ভেদাভেদ থাকবে না। সকলেই সমান সুযোগ ও সেবা পাবে। কাউকে বিশেষ কোনো সুযোগ-সুবিধা না দিয়ে সকলের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা থাকবে। সুশাসন সাম্যকে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ব্যক্তিগত, আইনগত অর্থাৎ সকল ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করে থাকে। রাজনীতিতে অংশগ্রহণ, ন্যায্য মজুরি পাওয়া, সামাজিক নিরাপত্তা লাভ, আইনের সমান সুযোগ লাভ প্রভৃতি বিষয় সাম্যের আওতাভুক্ত।
 
 
৭. কার্যকারিতা ও দক্ষতা: কার্যকারিতা ও দক্ষতার অর্থ হলো এমন প্রতিষ্ঠান ও কার্য প্রক্রিয়া স্থাপন করা যা রাষ্ট্রীয় সম্পদসমূহের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করে নাগরিকের সর্বোচ্চ প্রয়োজন পূরণ করে। সুশাসনে দক্ষতার বিষয়টির সাথে প্রাকৃতিক সম্পদের টেকসই ব্যবহার এবং পরিবেশ-প্রতিবেশের সংরক্ষণকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর সাথে পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের বিষয়টিও গভীরভাবে জড়িত। শুধু পরিকল্পনা গ্রহণ করলেই চলবে না। তা যথাযথভাবে যথাসময়ে বাস্তবায়িত করতে হবে।
 
 
৮. জবাবদিহিতা: জবাবদিহিতা হলো সুশাসনের মূল চাবিকাঠি। জবাবদিহিতা হচ্ছে সম্পাদিত কর্ম সম্পর্কে একজন ব্যক্তির ব্যাখ্যাদানের বাধ্যবাধকতা। এক্ষেত্রে সরকারের যেমন জনগণের কাছে তার কর্মের জন্য জবাবদিহি করতে হবে, তেমনি অন্যান্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেরও জবাবদিহি করতে হবে। জবাবদিহিতা না থাকলে সরকার স্বোচ্ছাচারী হতে পারে। সরকার স্বেচ্ছাচারী হলে সুশাসন থাকে না।
জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে প্রশাসনিক বা আমলাতান্ত্রিক জবাবদিহিতার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। রাজনৈতিক জবাবদিহিতা যদি দুর্বল হয় তবে তা সামাজিক ও অর্থনৈতিক- উভয় খাতকে প্রভাবিত করে। দুর্নীতি কমানোর ক্ষেত্রে রাজনৈতিক জবাবদিহিতা অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
 
রাজনৈতিক জবাবদিহিতার দু’টি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র রয়েছে। ক্ষেত্র দু’টি হলো-
ক) কার্যকরীকরণ: রাজনৈতিক জবাবদিহিতার প্রথম শর্ত হচ্ছে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। ‘অবাধ’ অর্থ- প্রয়োজনীয় স্বাধীনতা ব্যবহারের সমান সুযোগ। ‘নিরপেক্ষ’ অর্থ- নির্বাচনী আইনের প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা। একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর নির্বাচন হওয়া এবং সেটি প্রশাসনের সহায়তায় নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হবে। গণমাধ্যমগুলো জনগণ এবং সমর্থকদের মতামত তুলে ধরবে সেখানে সরকারের কোনো একচেটিয়া প্রভাব ও প্রাধান্য থাকবে না।
 
খ) জবাবদিহি: রাজনৈতিক জবাবদিহিতার আরেকটি শর্ত হচ্ছে জবাবদিহি। গণমাধ্যমে রাজনীতিবিদদের দ্বারা জনগণ পূর্ণ জবাবদিহিতা এবং সমর্থন গ্রহণ করে। দুর্নীতি, অর্থের বিনিময়ে ক্ষমতা দখল এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন এগুলো প্রকাশ করার জন্য স্বাধীন গণমাধ্যম প্রয়োজন। জবাবদিহিতার জন্য আইনের প্রয়োজন, যেগুলো নির্বাহী সদস্যদের জবাবদিহি করতে বাধ্য করে। জবাবদিহির অপর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে- বিরোধী রাজনৈতিক দলের কার্যকরী অংশগ্রহণ। বিরোধী রাজনৈতিক দলের কার্যকরী অংশগ্রহণ ছাড়া সরকার সুশাসন কায়েমে অনিচ্ছা প্রকাশ করতে পারে, দুর্নীতিপরায়ণ হতে পারে, স্বেচ্ছাচারী হতে পারে।
 
৯. বিকেন্দ্রীয়করণ: কোনো দেশের যাবতীয় কার্যাবলি শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে সুশৃঙ্খলভাবে সম্পাদন করা সম্ভবপর হয় না; তাই কেন্দ্রীয় সরকারকে তার কিছু কিছু ক্ষমতা স্থানীয় পর্যায়ে ছেড়ে দিতে হয়। এর ফলে সরকারের কার্যাবলি দক্ষতার সাথে সুষ্ঠুভাবে সম্পাদিত হয়। একেই ক্ষমতা বিকেন্দ্রীয়করণ বলা হয়। একটি কার্যকরী বিকেন্দ্রীয়করণ স্থানীয় পর্যায়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যাপক সুযোগ-সুবিধা প্রদান করতে পারে এবং জাতীয় পর্যায়ে সুশাসনের উন্নতিতে সাহায্য করে। বিকেন্দ্রীয়করণের ফলে স্থানীয় পর্যায়ে জনগণের চাহিদা পূরণ অধিকতর কার্যকরী হয়, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং স্থানীয় পর্যায়ে ক্ষমতায়ন হয়।
 
১০. স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা: একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থার উপস্থিতি সুশাসনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা ভিন্ন সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। সরকার শাসনকার্য পরিচালনা করতে গিয়ে অনেক সময় আইন-বহির্ভূত আচরণ করতে পারে। বিচারবিভাগ সরকারকে সঠিক পথে রাখার জন্য রুল জারি করতে পারে। অথবা সরকার যদি কোনো নাগরিকের অধিকারে হস্তক্ষেপ করে তাহলে ঐ নাগরিক বিচার বিভাগের মাধ্যমে তার অধিকার ফিরে পেতে পারে। যে দেশের বিচারবিভাগ যত বেশি দক্ষতা ও নিরপেক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করতে পারে সে দেশের সুশাসনের ভিত ততো বেশি মজবুত হয়। বিচার বিভাগ শাসন বিভাগকে সুনির্দিষ্ট গতিপথে পরিচালিত হতে সাহায্য করবে এবং নাগরিকের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করে ও আইনের শাসন অক্ষুণ্ন রেখে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সজীব ও প্রাণবন্ত রাখে। তাই সুশাসন ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা একে-অপরের পরিপূরক হিসেবে বিবেচিত। উভয়ের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন- নাগরিকদের কল্যাণ সাধন করে একটি সুষ্ঠু, স্বাধীন ও সমৃদ্ধশালী সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করা।
 
সুশাসন হলো একটি প্রত্যাশিত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রতিফলন। বর্তমান বিশ্বে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সুশাসনের ওপর সবিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সুশাসনের মাধ্যমেই দেশের মানুষ তাদের আগ্রহ বা প্রত্যাশাকে প্রকাশ করতে পারে, তাদের অধিকার ভোগ করে এবং তাদের চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারে। সুশাসনের ফলে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সম্পদগুলোর টেকসই উন্নয়ন ঘটে থাকে। বস্তুত রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য সুশাসন অত্যাবশ্যক।
 
সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নয়- রাষ্ট্রের সকল দিক ও পর্যায়ের উন্নয়নের জন্য সুশাসন জরুরি। রাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করা। সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা, মানবসত্তার মর্যাদা নিশ্চিত করা, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা। নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন ও সুষম সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা, ন্যায়ভিত্তিক, দুর্নীতিমুক্ত ও শুদ্ধাচারী সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন হলো সুশাসন প্রতিষ্ঠা। জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে আইনের শাসন, প্রশাসনের সর্বস্তরে গণতান্ত্রিক শাসন, মানবাধিকার সংরক্ষণ, সমতা, ন্যায়পরায়ণতা, দায়বদ্ধতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে। পাশাপাশি সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে সাধারণ জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং তাদের প্রতি শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটানো সম্ভবপর হবে।
 
 
সনুশাসন যখন থাকে না, তখন সরকারি সম্পদের অপচয়ের পাশাপাশি রাষ্ট্রের স্বার্থের পরিপন্থী নীতি-নির্ধারণের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা এবং বেসরকারি খাতের প্রতি সহযোগিতার অভাব থাকে। বর্তমানে বিশ্বের সর্বত্রই সরকারি খাতের পাশাপাশি নাগরিকদের কর্মসংস্থানে বেসরকারি খাতও যথেষ্ট অবদান রাখছে। তাই বেসরকারি খাতের প্রতি সরকারের সহযোগিতা না থাকলে রাষ্ট্রের বেকারত্ব বাড়বে। বেকারত্ব বাড়লে দারিদ্র্য বাড়বে। সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে সরকারি সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার হবে এবং দারিদ্র্যবিমোচন হবে এবং বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থান বাড়বে।
 
উপসংহারে এসে আমরা বলতে পারি, দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য বিমোচন হবে। বেকারত্ব দূর হবে, কর্মসংস্থান বাড়বে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। জবাবদিহিতামূলক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে। গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে- দেশ সুখী-সমৃদ্ধশালী হবে, ক্রমান্বয়ে উন্নতির চরম শিখরে উন্নীত হবে।
 
তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রায়ই বিতর্ক লক্ষ করা যায়- একটি দেশের সাধারণ মানুষের সর্বোত্তম কল্যাণ সাধনের জন্য গণতন্ত্র ও উন্নয়ন এ দু’টির মধ্যে কোনটি বেশি জরুরি? গণতন্ত্রের প্রবক্তারা মনে করেন, একমাত্র নির্ভেজাল গণতন্ত্রই একটি দেশের কার্যকর অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত ও নিশ্চিত করতে পারে। কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হলে চূড়ান্ত পর্যায়ে সেই দেশের সার্বিক জনকল্যাণ সাধিত হতে বাধ্য। সবার আগে চাই গণতন্ত্র। তাই গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে। গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা থাকলে একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি অর্জন কঠিন কিছু নয়। তারা আরও মনে করেন, গণতন্ত্রের মাধ্যমেই একটি দেশ ও সমাজ দ্রুত এগিয়ে যেতে পারে। তাই গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। তারা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির উদাহরণ টেনে বলতে চান, সমাজতন্ত্র বা অন্য কোনো অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সর্বোচ্চ জনকল্যাণ সাধন করতে পারে না। সমাজতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থা ব্যক্তির সৃজনশীলতাকে বাধাগ্রস্ত করে। কারণ সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উৎপাদন প্রক্রিয়া পরিচালিত হয় রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে। ব্যক্তির স্বাধীনতা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা সেখানে সীমিত। অন্যদিকে গণতন্ত্র মানুষের ব্যক্তিগত সৃজনশীলতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করে।
 
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং মুক্তবাজার অর্থনীতির জয়জয়কার। বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে তার আপন গতিতে। অন্যদিকে যারা নির্ভেজাল উন্নয়নে বিশ্বাসী এবং উন্নয়নের প্রয়োজনে সীমিত গণতন্ত্রকেও সমর্থন করেন তাদের মতে, শুধু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেই একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত এবং সর্বোচ্চ জনকল্যাণ সাধিত হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। বিশ্বের এমন অনেক দেশের উদাহরণ দেয়া যাবে যারা গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়েছে; কিন্তু সর্বোত্তম জনকল্যাণ সাধন করতে পারেনি। বিশ্ব আর্থ-রাজনৈতিক ব্যবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় উদাহরণ। কিন্তু সেই যুক্তরাষ্ট্রও কিন্তু তার দেশের সব শ্রেণী-পেশার মানুষের জন্য সর্বোত্তম কল্যাণ সাধন অথবা দারিদ্র্য দূরীকরণে সফল হতে পারেনি। মার্কিন যুুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ধনী ব্যক্তিদের বসবাস। কয়েক বছর আগে দি ইকোমনিস্ট পত্রিকার এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ তিন ধনী ব্যক্তির মিলিত মোট সম্পদের পরিমাণ বিশ্বের ৪৭টি স্বল্পোন্নত দেশের মোট জিডিপির প্রায় সমান। এটা যেমন এক দিকের চিত্র, এর বিপরীত চিত্র হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের পার্ক এবং অন্যান্য স্থানে এখনও অনেকেই খোলা আকাশের নিচে রাত যাপন করে। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের প্রশ্নাতীত গণতন্ত্র দেশটির সাধারণ মানুষের সর্বোত্তম কল্যাণ সাধন করতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের এক নম্বর অর্থনৈতিক শক্তি হলেও তারা নিজ দেশের জনগণের জন্য সুষম বণ্টন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারেনি। ফলে দেশটিতে এখনও ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য পর্বত প্রমাণ। শুধু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সর্বাধিক জনকল্যাণকর সমাজব্যবস্থার নিশ্চয়তা দিতে পারে না।
 
 
এদিকে যারা উন্নয়নের স্বার্থে গণতন্ত্রের প্রশ্নে কিছুটা হলেও ছাড় দিতে প্রস্তুত তারা দক্ষিণ এশিয়ার বিস্ময়কর দেশ মালয়েশিয়ার উদাহরণ দিয়ে থাকেন। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডা. মাহাথির মোহাম্মদ প্রায় ২২ বছর দেশটি শাসন করেছেন। তার সময়ে মালয়েশিয়ায় গণতন্ত্র কাক্সিক্ষত মাত্রায় ছিল না। কিন্তু উন্নয়ন হয়েছে বিস্ময়করভাবে। আর এটা সম্ভব হয়েছে শাসনক্ষমতার ধারাবাহিকতা বজায় থাকার কারণেই। মাহাথির মোহাম্মদের পর যারা মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়েছেন, তারা কিন্তু একইভাবে দেশটিকে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছেন না। উন্নয়নের গতি কিছুটা হলেও মন্থর হয়ে পড়েছে। মাহাথির মোহাম্মদের নেতৃত্বাধীন মালয়েশিয়া শাসনক্ষমতার ধারাবাহিকতা এবং উন্নয়নের গতি সচল রাখার পাশাপাশি আরও যে কাজটি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে করেছেন তা হল সর্বস্তরে সুশাসন প্রতিষ্ঠা। আমরা গণতন্ত্রই বলি আর উন্নয়নই বলি, সবকিছুর মূলে রয়েছে সুশাসন।
 
একটি দেশ যদি সমাজের সর্বস্তরে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারে তাহলে উন্নয়ন ও গণতন্ত্র উভয়ই সঠিকভাবে কাজ করতে পারে। বিশ্বে এমন একটি দেশেরও উদাহরণ দেয়া যাবে না, যারা সুশাসন প্রতিষ্ঠা ছাড়া সত্যিকার উন্নয়ন ঘটাতে পেরেছে। সেটা যতই গণতান্ত্রিক দেশ হোক না কেন। কর্পোরেট গুড গভর্নেন্স বলে একটি কথা সব দেশেই প্রচলিত আছে। সমাজের সর্বস্তরে যেমন সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন, তেমনি প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে অভ্যন্তরীণ সুশাসন প্রতিষ্ঠা করাও জরুরি। কারণ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিয়েই রাষ্ট্র গড়ে ওঠে। সমাজ ও প্রতিষ্ঠানে অভ্যন্তরীণ সুশাসন কাক্সিক্ষত মাত্রায় না থাকলে একটি দেশ কখনোই সার্বিকভাবে উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে পারে না। অর্থনৈতিকভাবে বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও শুধু সুশাসন প্রতিষ্ঠার অভাবে অনেক দেশ হতদরিদ্রই থেকে যাচ্ছে।
 
 
সুশাসন না থাকলে সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। দুর্নীতি ও অপরাধ বেড়ে যেতে পারে। আমাদের সমাজব্যবস্থার দিকে তাকালে আমরা কী দেখতে পাই? সরকার নানাভাবে সমাজে এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সুশাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে সুশাসন প্রতিষ্ঠার তাগিদ দেয়া হলেও নিন্মস্তরের প্রতিষ্ঠানগুলোতে কার্যকর সুশাসন প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় অবস্থার দৃশ্যমান কোনো উন্নতি হচ্ছে না। এক্ষেত্রে সাফল্য যতটা অর্জিত হওয়া উচিত ছিল তা হচ্ছে না। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা কিছুদিন আগে বলেছে, প্রতি বছর দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশের আড়াই থেকে তিন শতাংশ জিডিপি অর্জন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত বিপুল পরিমাণ টাকা প্রতি বছর দেশের বাইরে পাচার হয়ে যাচ্ছে। অথচ এসব টাকা যদি স্থানীয়ভাবে বিনিয়োগ হতো তাহলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন অনেকটাই ত্বরান্বিত হতে পারত। রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশেই সুশাসনের অভাব রয়েছে। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোর যে মাত্রায় জনসেবা প্রদান করার কথা ছিল, তারা তা দিতে পারছে না। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নির্বাহী পর্যায় থেকে যতই স্বচ্ছতার কথা বলা হোক না কেন, প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন নিশ্চিত করা না গেলে কোনো কাজ হবে না।
 
 
দুর্নীতি প্রতিষ্ঠানের উচ্চপর্যায় থেকে নিচের দিকে ধাবিত হয়। এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যা হল, ব্যক্তিখাতে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানগুলো লাভজনকভাবে পরিচালিত হলেও একই ধরনের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো বছরের পর বছর লোকসান দিয়ে চলেছে। এর অন্যতম কারণ সুশাসনের অভাব। রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালিত হয় প্রতিনিধির মাধ্যমে। এখানে মালিক থাকেন অনুপস্থিত। অর্থাৎ রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান মালিক নিজে পরিচালনা করেন না। এগুলো পরিচালিত হয় রাষ্ট্র কর্তৃক মনোনীত প্রতিনিধির মাধ্যমে। প্রতিনিধিরা কখনোই মালিকের মতো দায়িত্বশীল হন না। তারা মনে করেন, আমরা এসেছি মাত্র কয়েক বছরের জন্য। কাজেই ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারে যা করণীয় তা-ই করতে হবে। অন্যদিকে ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয় সরাসরি মালিকের অধীনে। ফলে সেখানে জবাবদিহিতা থাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে। ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি বা প্রতিষ্ঠানের জন্য ক্ষতিকর কিছু করে টিকে থাকা যায় না। ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি করে পার পাওয়া খুবই কঠিন।
 
কোনো দেশ যদি সত্যিকার অর্থে টেকসই উন্নয়ন সাধন করতে চায়, তাহলে তাকে প্রথমেই সর্বস্তরে সুশাসন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ সুশাসন না থাকলে একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও গণতন্ত্র বিপর্যস্ত হতে পারে। তাই সবার আগে একটি দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের সঙ্গে সুশাসনের কোনো বিরোধ নেই। বরং গণতন্ত্র ও উন্নয়নকে টেকসই এবং অধিকতর কার্যকর করতে হলে সুশাসনের হাত ধরে চলতে হবে। সুশাসন ছাড়া উন্নয়ন ও গণতন্ত্র পৃথকভাবে জনকল্যাণ সাধন করতে পারে না। তাই উন্নয়ন ও গণতন্ত্রকে সুশাসনের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে চলতে হয়।
 
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি ঘটিয়েছে। একসময় বাংলাদেশকে নিয়ে যারা উপহাস করত এখন তারাই বাংলাদেশকে ‘উন্নয়নের রোল মডেল’ হিসেবে আখ্যায়িত করছে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অগ্রযাত্রা শুরু করেছিল। কিন্তু ১৯৭৫-পরবর্তী বাংলাদেশ প্রায় ১৫ বছর সামরিক শাসনের আওতায় ছিল। এসময় দেশে সুশাসনের অভাব দৃষ্ট হয়। বিভিন্ন সেক্টরে ব্যাপক দুর্নীতি এবং অব্যবস্থা ব্যাপক মাত্রায় ছড়িয়ে পড়ে। ’৮০-র দশকের শেষদিকে বিদ্যুতের লোডশেডিং নামক চুরি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। এক পর্যায়ে লোডশেডিংয়ের হার ৪৫ শতাংশে উন্নীত হয়। সেই সময় (সম্ভবত ১৯৯০ সালে) বিশ্বব্যাংকের একজন ভাইস প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফরে এসে বিদ্যুতের রেকর্ড পরিমাণ লোডশেডিং দেখে মন্তব্য করেছিলেন, বাংলাদেশ যদি বিদ্যুতের লোডশেডিং সহনীয় মাত্রায় কমিয়ে আনতে পারে, তাহলে প্রতি বছর যে অর্থ সাশ্রয় হবে তা দিয়ে প্রতি ৪ বছর অন্তর একটি করে যমুনা সেতু নির্মাণ করা যেতে পারে। পরবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা শুরু হলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নতি শুরু করে।
 
 
বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ বিস্ময়কর উন্নতি অর্জন করে চলেছে। গত প্রায় ১০ বছর ধরে বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে গড়ে সাড়ে ৬ শতাংশের ওপর জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছে। বিশ্বের খুব কম দেশের পক্ষেই এমন অর্থনৈতিক সাফল্য প্রদর্শন করা সম্ভব হচ্ছে। জনগণের মাথাপিছু জাতীয় আয় যেখানে ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে ছিল ১২৯ মার্কিন ডলার, এখন তা ১ হাজার ৬০০ মার্কিন ডলার অতিক্রম করে গেছে। একসময় বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ ১০০ কোটি মার্কিন ডলারে নেমে এসেছিল। এখন তা প্রায় ৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ক্ষেত্রে সার্ক দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ভারতের পরেই। অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমাদের উল্লেখযোগ্য অর্জন রয়েছে। কিন্তু তারপরও আমরা সম্ভাবনার পুরোটা কাজে লাগাতে পারছি না। এজন্য মূলত সুশাসনের অভাবই দায়ী। তাই আমাদের এখন সুশাসন প্রতিষ্ঠার ওপরই বেশি জোর দিতে হবে।
আজকাল সব মহলেই উন্নয়ন উন্নয়ন বলে নানা কথা শোনা যাচ্ছে, যদিও খুব স্পষ্ট নয় এই কথা বলে তারা ঠিক কী বোঝাতে চায়। একদল লোক, তাঁদের মধ্যে রাজনীতিক রয়েছেন, পেশাদার কলম লিখিয়েও রয়েছেন, উন্নয়ন মানে প্রবৃদ্ধি, সে কথা বোঝাতে বিস্তর কসরত করছেন। কিন্তু শুধু প্রবৃদ্ধি যথেষ্ট নয়, প্রবৃদ্ধির সুষম বণ্টনও গুরুত্বপূর্ণ, সে কথাও কেউ কেউ বলছেন। এই দুই পক্ষের তর্ক-বিতর্ক থেকেই হোক বা অন্য কোনো কারণে, একটা বিষয়ে মোটামুটি ঐকমত্য রয়েছে যে সুশাসন ছাড়া প্রকৃত উন্নয়ন যেমন সম্ভব নয়, তেমনি সম্ভব নয় সে উন্নয়নের সুফল কমবেশি সবার কাছে অর্থপূর্ণভাবে পৌঁছে দেওয়া।
সম্প্রতি অর্থনীতিবিদ নজরুল ইসলাম গভর্নেন্স ফর ডেভেলপমেন্ট বা উন্নয়নের জন্য সুশাসন—এই নামে একটি বই লিখেছেন (পলগ্রেভ ম্যাকমিলান, নিউইয়র্ক ২০১৬)। এই গ্রন্থে জাতিসংঘে কর্মরত এই অর্থনীতিবিদের মোদ্দা বক্তব্য, উন্নয়নের অধিকাংশ সূচকের নিক্তিতে বাংলাদেশ গেল কয়েক দশকে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন অর্জন করেছে, কিন্তু এই উন্নয়নকে আরও কয়েক কদম এগিয়ে নেওয়া সম্ভব, তার সুফল সবার কাছে পৌঁছে দেওয়াও সম্ভব, যদি সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ আরও একটু মনোযোগী হয়। আর সে জন্য দরকার গোটা কয়েক কাঠামোগত পরিবর্তন।
সুশাসনের দুটো দিক, তার একদিকে দেশের মানুষ, যারা সে দেশের প্রকৃত মালিক। অন্যদিকে সরকার ও আমলাতন্ত্র, যারা দেশের মানুষের নামে সে দেশ শাসন করে। সরকার ও আমলাতন্ত্র যদি দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করে, তাহলে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সমস্যা বাধে যখন এই দুইয়ের মধ্যে ব্যবধান জন্মে, তাদের মধ্যে দেখা দেয় বিরোধ। আর এই বিরোধের কারণটা খুব সোজা। সরকার, তা নির্বাচিত বা ওপর থেকে জুড়ে বসা হোক, যখন দেশের মানুষের স্বার্থ বিবেচনা না করে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত থাকে, তখন প্রতিবাদ ওঠে দেশের মানুষের কাছ থেকে। ফলে দেখা দেয় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, যার ঢেউ এসে লাগে অর্থনীতিতে, বিঘ্নিত হয় দেশের মানুষের দৈনন্দিন জীবনচারিতা।
সুশাসন ব্যাপারটা শুনতে বেশ বায়বীয় মনে হলেও বস্তুত তা নির্ণয়যোগ্য একটি ধারণা। আমাদের দেশ খুব সুশাসিত, সে কথা বললেই হবে না, তা মেপে ও ওজন করে দেখতে হবে। আর সে কাজটা করা খুব কঠিন এমন কিছু নয়। পণ্ডিতদের সূত্র অনুসরণ করে নজরুল ইসলাম সুশাসনের মোট ছয়টি সূচক বা ইন্ডিকেটর চিহ্নিত করেছেন। সেগুলো হলো দায়বদ্ধতা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সহিংসতার অনুপস্থিতি, সরকারের কার্যকারিতা, নিয়মবিধির প্রায়োগিকতা, আইনের শাসন এবং দুর্নীতির নিয়ন্ত্রণ। সুনির্দিষ্ট উপাত্ত-ভিত্তির ব্যবহারের মাধ্যমে এই সূচকের প্রতিটির গুণাগুণ আমরা খুবই বৈজ্ঞানিকভাবে নির্ণয় করতে পারি। এই পদ্ধতির ভিত্তিতেই কোন দেশ কতটা দুর্নীতিপরায়ণ বা কোন দেশ কতটা মুক্ত, তার বছরওয়ারি হিসাব চালু হয়েছে, যার সঙ্গে আমাদের তিক্ত-মধুর সম্পর্ক রয়েছে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা যদি এই ছয়টি সূচকের ব্যবহার করি, তাহলে ফল কী দাঁড়ায়? নজরুল প্রধানত বিশ্বব্যাংকের উপাত্ত ব্যবহার করে ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন চার্ট প্রস্তুত করেছেন, দেখা যাচ্ছে তার অধিকাংশেই বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বা শিল্পোন্নত দেশগুলোর চেয়ে লক্ষণীয়ভাবে পিছিয়ে রয়েছে। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের চেয়েও বাংলাদেশের সুশাসন পরিস্থিতি নেতিবাচক। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ, নিয়মবিধির প্রতিপালন ও আইনের শাসন, এই সূচকসমূহে বাংলাদেশ এই গ্রুপের সবার নিচে। সরকারের কার্যকারিতার প্রশ্নে বাংলাদেশ নেপালের চেয়ে সামান্য ওপরে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রশ্নে বাংলাদেশ তার দুই প্রতিবেশী নেপাল ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে। এক দায়বদ্ধতার প্রশ্নেই বাংলাদেশ ভারত ছাড়া বাকি সার্কভুক্ত দেশ থেকে এগিয়ে।
যে প্রবৃদ্ধি নিয়ে আমাদের এত কথা, সেখানেও কিন্তু আমরা পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহ বা ভারত থেকে পিছিয়ে। নজরুল জানাচ্ছেন, ১৯৮১-২০১০ এই সময়কালে বাংলাদেশের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার গড়ে ৪ দশমিক ৮ শতাংশ। এর পরের বছরগুলোতে অবশ্য বাংলাদেশ ৬ শতাংশ বা তার চেয়েও অধিক বার্ষিক হারে প্রবৃদ্ধি অর্জনে সক্ষম হয়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির আবক্রপথ বা ট্রাজেকটরি যে সর্বদা ঊর্ধ্বমুখী, তা নয়। অনেক সময় তাকে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে, মূলত রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি-পথ যে মোটেই ঋজু নয়, সে কথা আরও স্পষ্ট হয় যখন একই সময়ে অন্যান্য দেশ বা গ্রুপ কোনো আবক্রপথ ধরে চলেছে, তার একটা তুলনামূলক হিসাব নেই। ১৯৬১-১৯৮০ সালের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার গড় বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ শতাংশ। ১৯৮৪-২০১২ সময়কালে চীনের অর্থনীতি বৃদ্ধি পেয়েছে ১০ শতাংশেরও অধিক হারে। প্রতিবেশী ভারতে ১৯৯১-২০১০ সালের মধ্যে বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৮ শতাংশ।
আমরা যদি সুশাসনের ভিতটি অর্থাৎ নজরুল যে ছয়টি সূচক চিহ্নিত করেছেন, তা আরও খানিকটা মজবুত করতে পারতাম, তার ফল হতো দুই রকম। প্রথমত, আইনের শাসনের অভাব বা দুর্নীতি আমাদের প্রতিদিন নানাভাবে আক্রান্ত করে, জীবনের মানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই দুই খাতে পরিবর্তন অর্জিত হলে নাগরিক জীবন কিছুটা হলেও দুর্ভাবনামুক্ত হতো। অন্যদিকে দায়বদ্ধতা বাড়লে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জিত হলে, সহিংসতা ঠেকানো গেলে বা সরকারের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পেলে অর্থনীতি অনেক বেশি স্থিতিশীল ভিত্তির ওপর স্থাপিত হয়, তার আবক্রপথ অনেক বেশি আস্থাপূর্ণ হয়। অর্থনীতিকে স্থিতিশীল ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো সম্ভব হলে নাগরিক জীবনে অধিক স্বস্তি আসে, ভবিষ্যৎ নিয়ে তাদের ক্রমবর্ধমান আস্থা জন্মে।
অতএব উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে, কিন্তু কীভাবে? এ ব্যাপারে নজরুল ইসলাম একটি ব্যবস্থাপত্র নির্দেশ করেছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা সামলানোর জন্য নজরুল সরকারের মেয়াদ পাঁচ থেকে কমিয়ে চারে আনার প্রস্তাব করেছেন। তাঁর যুক্তি, সরকারের মেয়াদ কম হলে হরতাল বা সহিংস রাজনীতির প্রবণতা কিছুটা হলেও কমবে। পাশাপাশি তিনি বর্তমানের নির্বাচন পদ্ধতি বদলিয়ে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের প্রস্তাব করেছেন। মোট ভোটের ৪০ শতাংশ বা তার চেয়েও কম পেয়ে বাংলাদেশে গত পাঁচটি নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়েছে। তাঁর বিশ্বাস, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব অর্জিত হলে একদিকে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভিত্তি যেমন জোরদার হবে, তেমনি এখন যাঁরা রাজনৈতিক ক্ষমতা বলয়ের বাইরে রয়ে যাচ্ছেন, তাঁরা প্রতিনিধিত্বের সুযোগ পাবেন।
সুশাসনের একটি লক্ষ্য দুর্নীতিমুক্ত ব্যবস্থা গড়ে তোলা। দুর্নীতি বলতে আমরা অনেক সময় নাগরিক জীবনে ব্যক্তিগতভাবে কী সংকটের মুখে পড়ি, সে বিবেচনাতেই সীমাবদ্ধ থাকি। অথচ দুর্নীতির ফলে আসল ক্ষতি হয় পুরো দেশের, বিশেষত যখন রাজনৈতিক নীতিনির্ধারকেরা আমলাতন্ত্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেশের স্বার্থবিরোধী নীতি বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বাংলাদেশে এটা কত বড় সমস্যা নজরুল তার গোটা কয়েক উদাহরণ দিয়েছেন। যেমন নিজস্ব ক্ষমতাভিত্তিক উদ্যোগের বদলে বিদেশি কোম্পানিভিত্তিক ব্যবস্থাপনায় বিদ্যুৎ খাত ছেড়ে দেওয়া। এর ফলে নিজস্ব উৎস থেকে জ্বালানি সংগ্রহের যে উদ্যোগ বাংলাদেশ নিতে পারত, তা কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে।
একইভাবে নীতিগত ভুলের জন্য বাংলাদেশকে এখন নিজের গ্যাস বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দিয়ে ফের তাদের কাছ থেকে চড়া দামে কিনতে হচ্ছে। এর ফলে কারও কারও পকেট ভারী হয়তো হয়েছে, কিন্তু ক্ষতি হচ্ছে দেশের।
এসব রাজনৈতিক অথবা প্রশাসনিক দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা অসম্ভব ব্যাপার নয়। এর জন্য দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা, যার অভাব এখন পর্যন্ত প্রবল। তবে মানতে হবে বাংলাদেশ নানা সময়ে বিভিন্ন সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে, উদ্দেশ্যের দিক দিয়ে তার সাধুতা অস্বীকার করা যায় না। যেমন সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি কর্মচারীদের বেতন হারের পরিবর্তন হয়েছে। সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতিবিমুখ করতে হলে তাঁদের যথোপযুক্ত বেতন দিতে হবে, এ ব্যাপারে সব মহলেই একমত। রাজনৈতিক সংস্কার ও অধিক গণতান্ত্রিক কর্মপন্থার ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলো আগ্রহী, সাম্প্রতিক সময়ে তারও ইঙ্গিত মিলেছে। তবে এসব শুধু লোক দেখানো, না এর পেছনে প্রকৃত সংস্কারের কোনো সদিচ্ছা আছে, তা অবশ্য এখনো প্রমাণের অপেক্ষায়।
সংস্কারের সম্ভাবনার কথা বলতে গিয়ে নজরুল ঠিকই বলেছেন, কী পরিবর্তন চাই, কেন পরিবর্তন চাই, সে ব্যাপারে খুবই জরুরি ব্যাপক নাগরিক সংলাপ। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতৈক্য ও সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে সহমত ছাড়া কোনো সংস্কারই দীর্ঘস্থায়ী হবে না। এ ব্যাপারে আইন পরিষদের পাশাপাশি তথ্যমাধ্যমের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
মোটের ওপর নজরুল ইসলামের এই বইটি আমাদের চলতি সমস্যাগুলো চিহ্নিত করার পাশাপাশি তা থেকে উত্তরণের সম্ভাব্য পথ কী হতে পারে, তার বাস্তবসম্মত কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। সব যে আমাদের বিনা তর্কে মানতে হবে তা নয়। কিন্তু তর্ক হোক, আলোচনা হোক, সামনে এগোনোর সেটি সবচেয়ে উত্তম পথ। নজরুল ইসলামের এই গ্রন্থ সেই বিতর্ক শুরুর একটি ক্ষেত্র প্রস্তুত করল, এ কথা বলা বোধ হয় ভুল হবে না।

5 Comments

  1. Alex TM
    April 1, 2015 at 20:27
    Reply

    Dolorum nascetur quibusdam bibendum nesciunt torquent vehicula, nostra? Nisl? Excepteur repellat provident, laboriosam! Nullam vel.

    • Alex TM
      April 1, 2015 at 20:28
      Reply

      Corporis quasi dicta voluptates, rerum vero eos quaerat, quo aliqua voluptates suspendisse quod tempus! Interdum.

      • Alex TM
        April 1, 2015 at 20:28
        Reply

        Egestas molestias erat impedit blanditiis quam, proident rutrum iste? Illum? Aenean proin. Nostrum pretium, commodi.

Leave a Reply

Close
Close